Featured Post

    রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯


    গল্পের ভূত আমাদের মাথায় থাকে না, পাশে পাশে ঘুরে
    দিনটাই এমন যে একটা প্রেম প্রেম ভাব আছে। এই দিনে এসে লেয়ারবাগের প্রেমিকা নিয়ে ভাবা বা আমাদের যাপিত জীবনের প্রেম নিয়ে ভাবতে গেলে নির্মোহ হওয়ার সুযোগ একটু কমই থাকে। তারপরও নির্মোহ হওয়ার ভান করি, দেখি কোথায় লেয়ারবাগ আর তার প্রেমিকা। খুঁজি, খুঁজতে গিয়ে এক অদ্ভুত সমীকরণ এসে সামনে দাঁড়ায়। আর আমাদের জীবনের গল্পকেও যদি আমরা একটা সিনেমার গল্প হিসেবে ভাবি তাহলে এই ক্লাইমেক্সের ফাঁকে অন্য গল্পও বলে নেওয়া উচিত। তাই একটু অন্য অবস্থান থেকে গল্পটা বলার চেষ্টা করি, দেখি কি দাঁড়ায়।
    এইখানে একটা হিমু গাছ আছে, লোকে তার নাম জানে না
    মূল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বলতে গেলে শহরের বাইরে আরও একটি উপশহরের রাস্তার পাশে বসেছিলো তারা। হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি টিনের চালে ঝমঝম শব্দের উপস্থিতি জানান দেয়। গরম গরম জিলিপি ভাজায় খাওয়ার পর হাতে থাকা মিষ্টির শিড়া চেটেপুটে শেষ করতে করতে কোন আচমটা টানে যেন হাত পকেটে চলে যায়। অন্যের পকেটে নয়, নিজেরই পকেটে। পকেট থেকে সাদা কাগজের ভাজ করা একটি চিঠি মেলে ধরে লেয়ারবাগ। বলে এ তার প্রেমিকার পাঠানো চিঠি। হ্যাঁ, এই উত্তরআধুনিক যুগে লেয়ারবাগের কাছে তার প্রেমিকার চিঠি একটা আস্ত মানুষের চেয়ে বেশী তরতাজা আর আরো বেশী প্রাণময় হয়ে ধরা দেয়। বিপরীতে বসে থাকা তার বন্ধুটির চোখে রাজ্যের কৌতুহল। সত্যিই কি লেয়ারবাগ তার কল্পনার রাজকন্যার কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটি মেলে ধরলেন? তার চোখে মুখে এখনো অবিশ্বাস খেলা করে। কিন্তু লেয়ারবাগের প্রেমিকার চিঠি যে এখনো বাস্তব! যেই চিঠি কিনা প্রমাণ করে কালিদাসের ডাকে পাঠানো চিঠিতে এই যুগে আসা মানুষ লেয়ারবাগ।  চিঠির শেষ লাইনে কি অদ্ভুত প্রেমের জন্ম দিয়ে বালিকা (আসলেই কি বালিকা? নাকি আর জন্মে সে আফ্রোদিতির কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ আশির্বাদে নোমাসের কাছে সমর্পণ করছে তার প্রেম?) বলে, তোমাকে কি তুমি করে বলা যায়?
     চিঠি একটি নৈশর্গিক মৃত্যুর নাম, আর তারে ভুলে থাকা কঠিন
    সে এক যুগ ছিলো। নির্দিষ্ট স্থানে প্রেমিকা আসবে, বহু প্রতীক্ষার এই খবর অনেক সময় পাওয়া যেতো নির্ধারিত সময় চলে যাওয়ার পরে। আর এই আক্ষেপ বুকে চাপা দিতে হাতে পাওয়া যেতো তরিঘরি করে লেখা একটা চিঠি। দুনিয়া তো ডিজ্যুস হয়ে গেছে কতকাল। যেদিন থেকে দুই টাকায় কথার রাত্রী পোহাতো সেই ডিজ্যুস দুনিয়ায় এখনো বাহকের হাত ধরে গোপনে আসে প্রেমিকার চিঠি। লেয়ারবাগ ছাড়া আর কার আছে সে ভাগ্য?
    উটকো একটা বাস কোত্থেকে যে হাওয়ার মতো এসে উড়ে চলে যায়…
    কিছুটা ঈর্ষা তোমার প্রেমিকারে নিয়া। তার কিছুটা সংগত কারণও আছে। সেই কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু শুরুটা যে খুব একটা দুর্বল তা বলতে পারি না। তবুও বলি, গত পরশু হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো, প্রিয় বন্ধুটির দীর্ঘদিনের প্রেমিকা তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বলেছিলো, তুমি আমার বিয়েতে এসো না। আর্ন্তজালের দুনিয়ায় তাই হাস্যোজ্জল একটা বিয়ের ছবি দেখে বন্ধুর জন্য কিছুটা মন আমারো কেঁদেছিলো। এইসব মেকি সম্পর্কের দিনগুলোতে আমরা যে একটা পারস্পরিক সৌহার্দ্যের স্বপ্নে বিভোর জীবন চেয়েছিলাম তার কথা মনে পড়েই একা একা ভেসেছিলাম হাহাকারের সমুদ্রে। বন্ধুরে, এইসব তো আমাদের জন্যই। এ ঘটনারও উল্টোপিঠে লেখা আছে আরও এক আক্ষেপের নাম। সেখানেও গল্প ত্রিভুজ প্রেমের। কিন্তু এই প্রেম ও এইসব মায়াময় পৃথিবী থেকে কিছুটা দূরে, বা তারও চেয়ে বহুদূরে এক অদ্ভুত পৃথিবী গড়ে যে বসে আছি আমি। সেই পৃথিবীর খবর কি তুই জানিস? না জানলেও জেনে রাখ, এইখানেই প্রেম করে লেয়ারবাগ, একটা বায়বীয় জীবনের চেয়ে আরও দৃঢ় স্বপ্নের কথা বলবো বলে সেখানে প্রতিদিনই নতুন গল্প আসে। আর সেই গল্পেরই একজন চরিত্র লেয়ারবাগের প্রেমিকা।
    Jason deCaires Taylor








    একটা ধূসর সূর্যের স্বপ্নের কথা তার জন্য
    আমরা এখন কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক আর কিছুটা স্বপ্ন দৃশ্যের ভেতর। তার আগে যখন স্বপ্ন আর বাস্তবের ঘোর ছিলো না, এই বৃষ্টিবেলায় মুঠোফোনে তার বার্তা আসে “চলো সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যাই, অন্ধকারে খালি পায়ে চলি আর বলি আমরা দু’জন সাইকেল হিমু”। খিকজ! এমন করে কি বলতে হয় বোকা? তুই বেটা জানিস না, হিমু-রা নিজেদের নাম বলে না। নগরের সড়ক দ্বীপগুলোতে দাঁড়িয়ে পাখিরা তার নাম প্রচার করে। শহরের এইসব বোকা বোকা নাগরিকরা হিমুর নাম জানতে জানতে জেনে যায় সড়ক দ্বীপগুলোতে বাস করা পাখিদের ঠিকানা। আর ঐ দিকে বালিকা কি মধুর হাসি দেয়। মায়াভরা হাসি। লাখ টাকা দিয়াও তুমি এই হাসি পাবা না। তার হাসির কথা বলতে বলতে আমার ঘুম পায়। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি আমিও এক শিউলীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চারপাশের কাদামাটির সড়ক জুড়ে অজস্র শিউলীফুল। যেন ফুলের পাটি বিছিয়ে বসে আছে কবিয়াল। ঘুম ভাঙলেই শুরু হবে গান। অথচ শিউলীমালা এইসব জানে না। নোমাস, এইসব আসলে একটা প্রতিবাস্তবের চিহ্ন। আমরা যখন একটা একটা করে এইসব দেয়াল ভেঙে নতুন দুনিয়া বানাবো, তখন সে কি দূর থেকে দেখবে? নাকি সেও হবে সৈনিক?
    চলো ভুল ভাঙা রাস্তার নাম বলি গন্তব্য
    সেদিন কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাকলো। পেছনে তাকালে কোনও সুইডিশ তরুনীর দেখা পাই না। দেখা পাইনা কোনও সলাজ চোখ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা রমনীর। অথচ কি দারুণ মৃত্যুগন্ধী সময় ছিলো জীবনে, তা তুমি জানো লেয়ারবাগ। তোমার প্রেমিকা সেইসব দিনের গভীর থেকে উঠে আসা কেবল একটা রহস্যের নাম ছিলো না। ছিলো আমাদের জীন থেকে বেড়িয়ে আসা জীবন রহস্যের মতো একটা মুখ অথবা সত্যিই সে একটা মিথ। কিন্তু তুমি আর তোমার সেই ডাকপিয়ন বন্ধুটি কখনো কি গুনে দেখেছো এইসব করতে গিয়ে কতটা ছবির মতো হারিয়ে গেছে তোমাদের হৃদয়? ভুলে যাও এইসব অস্পৃশ্য বেদনাবোধ। চোখ মেলে তাকালেই তুমি দেখতে পাবে একটা সবুজ সড়ক পেরিয়ে গেছে শহর বন্দর গ্রাম জনপদ। দূরে কোনও এক অশোক গাছের ছায়ায় পিড়া পেতে বসে আছে নরসুন্দর। একটি বালক ঘাড় গুঁজে নিজেকে সাফ-সুতরো করে নিচ্ছে। গাছের শাখায় বসে কিচিরমিচির করছে পাখিরা। এইবার চোখ মেলে তাকাও। দেখো কি সবুজ আর আশ্রয়ের ছায়া হয়ে গেছে তোমার প্রেমিকার চোখ, দেখতে পাচ্ছো লেয়ারবাগ?
    আমি নই বলো তুমি, তুমি নও বল আমি
    এখনো দ্বিধার সড়ক বড় বেশী বন্ধুর। তোমার কাছে তাই একটা নিয়োগ পত্র এসেছে দেখো। ভেতরে পদবীর স্থলে লেখা হাওয়া ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। হ্যাঁ বন্ধু, এই হাওয়া ঘরই তোমার আমার ঠিকানা। নীল খামে ভরা ঐ চিঠি পাঠিয়েছে স্বয়ং জিউস। সেও আসলে পূর্ব জন্মে তোমার আমার যমজ ভাই ছিলো কিনা! তাকে বলে দাও, উত্তরের কোনও শেষ নেই। ডাক পিয়নের কাছ থেকে তুমি বুঝে নিয়েছো হাওয়া ঘরের দায়িত্ব। যার ভেতর রাজকন্যার মতো দেখতে একজন মানুষ রয়েছে। সেই মুখ কেবল মিথের কাছে আটকে থাকা কোনও দেবী নয় লেয়ারবাগ, সে তোমার প্রেমিকা।
    --
    আর্টওয়ার্কসঃ  Monica Ramos, Jason deCaires Taylor

    লেয়ারবাগের প্রেমিকা

    at রবিবার, নভেম্বর ১৭, ২০১৯  |  No comments


    গল্পের ভূত আমাদের মাথায় থাকে না, পাশে পাশে ঘুরে
    দিনটাই এমন যে একটা প্রেম প্রেম ভাব আছে। এই দিনে এসে লেয়ারবাগের প্রেমিকা নিয়ে ভাবা বা আমাদের যাপিত জীবনের প্রেম নিয়ে ভাবতে গেলে নির্মোহ হওয়ার সুযোগ একটু কমই থাকে। তারপরও নির্মোহ হওয়ার ভান করি, দেখি কোথায় লেয়ারবাগ আর তার প্রেমিকা। খুঁজি, খুঁজতে গিয়ে এক অদ্ভুত সমীকরণ এসে সামনে দাঁড়ায়। আর আমাদের জীবনের গল্পকেও যদি আমরা একটা সিনেমার গল্প হিসেবে ভাবি তাহলে এই ক্লাইমেক্সের ফাঁকে অন্য গল্পও বলে নেওয়া উচিত। তাই একটু অন্য অবস্থান থেকে গল্পটা বলার চেষ্টা করি, দেখি কি দাঁড়ায়।
    এইখানে একটা হিমু গাছ আছে, লোকে তার নাম জানে না
    মূল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বলতে গেলে শহরের বাইরে আরও একটি উপশহরের রাস্তার পাশে বসেছিলো তারা। হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি টিনের চালে ঝমঝম শব্দের উপস্থিতি জানান দেয়। গরম গরম জিলিপি ভাজায় খাওয়ার পর হাতে থাকা মিষ্টির শিড়া চেটেপুটে শেষ করতে করতে কোন আচমটা টানে যেন হাত পকেটে চলে যায়। অন্যের পকেটে নয়, নিজেরই পকেটে। পকেট থেকে সাদা কাগজের ভাজ করা একটি চিঠি মেলে ধরে লেয়ারবাগ। বলে এ তার প্রেমিকার পাঠানো চিঠি। হ্যাঁ, এই উত্তরআধুনিক যুগে লেয়ারবাগের কাছে তার প্রেমিকার চিঠি একটা আস্ত মানুষের চেয়ে বেশী তরতাজা আর আরো বেশী প্রাণময় হয়ে ধরা দেয়। বিপরীতে বসে থাকা তার বন্ধুটির চোখে রাজ্যের কৌতুহল। সত্যিই কি লেয়ারবাগ তার কল্পনার রাজকন্যার কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটি মেলে ধরলেন? তার চোখে মুখে এখনো অবিশ্বাস খেলা করে। কিন্তু লেয়ারবাগের প্রেমিকার চিঠি যে এখনো বাস্তব! যেই চিঠি কিনা প্রমাণ করে কালিদাসের ডাকে পাঠানো চিঠিতে এই যুগে আসা মানুষ লেয়ারবাগ।  চিঠির শেষ লাইনে কি অদ্ভুত প্রেমের জন্ম দিয়ে বালিকা (আসলেই কি বালিকা? নাকি আর জন্মে সে আফ্রোদিতির কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ আশির্বাদে নোমাসের কাছে সমর্পণ করছে তার প্রেম?) বলে, তোমাকে কি তুমি করে বলা যায়?
     চিঠি একটি নৈশর্গিক মৃত্যুর নাম, আর তারে ভুলে থাকা কঠিন
    সে এক যুগ ছিলো। নির্দিষ্ট স্থানে প্রেমিকা আসবে, বহু প্রতীক্ষার এই খবর অনেক সময় পাওয়া যেতো নির্ধারিত সময় চলে যাওয়ার পরে। আর এই আক্ষেপ বুকে চাপা দিতে হাতে পাওয়া যেতো তরিঘরি করে লেখা একটা চিঠি। দুনিয়া তো ডিজ্যুস হয়ে গেছে কতকাল। যেদিন থেকে দুই টাকায় কথার রাত্রী পোহাতো সেই ডিজ্যুস দুনিয়ায় এখনো বাহকের হাত ধরে গোপনে আসে প্রেমিকার চিঠি। লেয়ারবাগ ছাড়া আর কার আছে সে ভাগ্য?
    উটকো একটা বাস কোত্থেকে যে হাওয়ার মতো এসে উড়ে চলে যায়…
    কিছুটা ঈর্ষা তোমার প্রেমিকারে নিয়া। তার কিছুটা সংগত কারণও আছে। সেই কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু শুরুটা যে খুব একটা দুর্বল তা বলতে পারি না। তবুও বলি, গত পরশু হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো, প্রিয় বন্ধুটির দীর্ঘদিনের প্রেমিকা তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বলেছিলো, তুমি আমার বিয়েতে এসো না। আর্ন্তজালের দুনিয়ায় তাই হাস্যোজ্জল একটা বিয়ের ছবি দেখে বন্ধুর জন্য কিছুটা মন আমারো কেঁদেছিলো। এইসব মেকি সম্পর্কের দিনগুলোতে আমরা যে একটা পারস্পরিক সৌহার্দ্যের স্বপ্নে বিভোর জীবন চেয়েছিলাম তার কথা মনে পড়েই একা একা ভেসেছিলাম হাহাকারের সমুদ্রে। বন্ধুরে, এইসব তো আমাদের জন্যই। এ ঘটনারও উল্টোপিঠে লেখা আছে আরও এক আক্ষেপের নাম। সেখানেও গল্প ত্রিভুজ প্রেমের। কিন্তু এই প্রেম ও এইসব মায়াময় পৃথিবী থেকে কিছুটা দূরে, বা তারও চেয়ে বহুদূরে এক অদ্ভুত পৃথিবী গড়ে যে বসে আছি আমি। সেই পৃথিবীর খবর কি তুই জানিস? না জানলেও জেনে রাখ, এইখানেই প্রেম করে লেয়ারবাগ, একটা বায়বীয় জীবনের চেয়ে আরও দৃঢ় স্বপ্নের কথা বলবো বলে সেখানে প্রতিদিনই নতুন গল্প আসে। আর সেই গল্পেরই একজন চরিত্র লেয়ারবাগের প্রেমিকা।
    Jason deCaires Taylor








    একটা ধূসর সূর্যের স্বপ্নের কথা তার জন্য
    আমরা এখন কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক আর কিছুটা স্বপ্ন দৃশ্যের ভেতর। তার আগে যখন স্বপ্ন আর বাস্তবের ঘোর ছিলো না, এই বৃষ্টিবেলায় মুঠোফোনে তার বার্তা আসে “চলো সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যাই, অন্ধকারে খালি পায়ে চলি আর বলি আমরা দু’জন সাইকেল হিমু”। খিকজ! এমন করে কি বলতে হয় বোকা? তুই বেটা জানিস না, হিমু-রা নিজেদের নাম বলে না। নগরের সড়ক দ্বীপগুলোতে দাঁড়িয়ে পাখিরা তার নাম প্রচার করে। শহরের এইসব বোকা বোকা নাগরিকরা হিমুর নাম জানতে জানতে জেনে যায় সড়ক দ্বীপগুলোতে বাস করা পাখিদের ঠিকানা। আর ঐ দিকে বালিকা কি মধুর হাসি দেয়। মায়াভরা হাসি। লাখ টাকা দিয়াও তুমি এই হাসি পাবা না। তার হাসির কথা বলতে বলতে আমার ঘুম পায়। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি আমিও এক শিউলীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চারপাশের কাদামাটির সড়ক জুড়ে অজস্র শিউলীফুল। যেন ফুলের পাটি বিছিয়ে বসে আছে কবিয়াল। ঘুম ভাঙলেই শুরু হবে গান। অথচ শিউলীমালা এইসব জানে না। নোমাস, এইসব আসলে একটা প্রতিবাস্তবের চিহ্ন। আমরা যখন একটা একটা করে এইসব দেয়াল ভেঙে নতুন দুনিয়া বানাবো, তখন সে কি দূর থেকে দেখবে? নাকি সেও হবে সৈনিক?
    চলো ভুল ভাঙা রাস্তার নাম বলি গন্তব্য
    সেদিন কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাকলো। পেছনে তাকালে কোনও সুইডিশ তরুনীর দেখা পাই না। দেখা পাইনা কোনও সলাজ চোখ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা রমনীর। অথচ কি দারুণ মৃত্যুগন্ধী সময় ছিলো জীবনে, তা তুমি জানো লেয়ারবাগ। তোমার প্রেমিকা সেইসব দিনের গভীর থেকে উঠে আসা কেবল একটা রহস্যের নাম ছিলো না। ছিলো আমাদের জীন থেকে বেড়িয়ে আসা জীবন রহস্যের মতো একটা মুখ অথবা সত্যিই সে একটা মিথ। কিন্তু তুমি আর তোমার সেই ডাকপিয়ন বন্ধুটি কখনো কি গুনে দেখেছো এইসব করতে গিয়ে কতটা ছবির মতো হারিয়ে গেছে তোমাদের হৃদয়? ভুলে যাও এইসব অস্পৃশ্য বেদনাবোধ। চোখ মেলে তাকালেই তুমি দেখতে পাবে একটা সবুজ সড়ক পেরিয়ে গেছে শহর বন্দর গ্রাম জনপদ। দূরে কোনও এক অশোক গাছের ছায়ায় পিড়া পেতে বসে আছে নরসুন্দর। একটি বালক ঘাড় গুঁজে নিজেকে সাফ-সুতরো করে নিচ্ছে। গাছের শাখায় বসে কিচিরমিচির করছে পাখিরা। এইবার চোখ মেলে তাকাও। দেখো কি সবুজ আর আশ্রয়ের ছায়া হয়ে গেছে তোমার প্রেমিকার চোখ, দেখতে পাচ্ছো লেয়ারবাগ?
    আমি নই বলো তুমি, তুমি নও বল আমি
    এখনো দ্বিধার সড়ক বড় বেশী বন্ধুর। তোমার কাছে তাই একটা নিয়োগ পত্র এসেছে দেখো। ভেতরে পদবীর স্থলে লেখা হাওয়া ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। হ্যাঁ বন্ধু, এই হাওয়া ঘরই তোমার আমার ঠিকানা। নীল খামে ভরা ঐ চিঠি পাঠিয়েছে স্বয়ং জিউস। সেও আসলে পূর্ব জন্মে তোমার আমার যমজ ভাই ছিলো কিনা! তাকে বলে দাও, উত্তরের কোনও শেষ নেই। ডাক পিয়নের কাছ থেকে তুমি বুঝে নিয়েছো হাওয়া ঘরের দায়িত্ব। যার ভেতর রাজকন্যার মতো দেখতে একজন মানুষ রয়েছে। সেই মুখ কেবল মিথের কাছে আটকে থাকা কোনও দেবী নয় লেয়ারবাগ, সে তোমার প্রেমিকা।
    --
    আর্টওয়ার্কসঃ  Monica Ramos, Jason deCaires Taylor

    Read More

    বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০১৭


    আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ১৯৮৫ সালে জন্ম। সিনেমায় নামার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীতিশাস্ত্র নিয়া পড়াশোনা করছেন। তারপর নিজের প্রোডাকশন হাউস থেইক্যা বানাইছে শর্টফিল্ম, টিভি বিজ্ঞাপন। ২০১৬ সালে তার প্রথম ফিচার ফিল্ম লাইভ ফ্রম ঢাকা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টে প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ২৭ তম সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা নির্মাতা হিসেবে সিলভার স্ক্রিন ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার পায় মোস্তফা মনোয়ার। এশিয়ান ফিল্ম ভল্ট এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয় সাদ এর লগে। এইটা এইখানে নিজের ভাষায় তর্জমা করা গেলো। 


    প্রশ্ন: সিনেমা বানাইতে আসার আগে তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছ, পড়াশোনা শেষে সিনেমা বানানোর দিকে আসার ভুত কোইত্থ্যাইক্যা আইলো?
    সাদ: সত্যি কইতে কি আমি জানিনা। আমি একটুও মনে করতে পারতেছি না কেন আমি আমার পয়লা স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম বা ঠিক কোনটা আমারে উৎসাহ দিছিলো কি না। তবে আমি ছবি দেখতে পছন্দ করতাম। কিন্তু তার মানে এই না, যে আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম যে আমি সিনেমায় কাজ করবো। আমার মনে হয়, সিনেমা আমারে কিছু দিতে পারে, মনে হইলো এইটা জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও হইতে পারে। এইটা ঠিক যেই রকম উত্তর আশা করছেন এই রকম না, অনেক হতাশা থাকলেও সিনেমা নির্মাণ আমাকে জীবন যাপনের একটা পথ বাৎলে দিছে।

    প্রশ্ন: তোমার অলরেডি একটা প্রোডাকশন হাউজ আছে। যেখান থেইকা শর্ট ফিল্ম, টিভি বিজ্ঞাপন বানাও। এইটা সম্পর্কে কি বলবা? মানে তুমি কি এইটা দিয়েই সিনেমার জন্য টাকা যোগার করলা?
    সাদ: আমার মনে হইতেছিলো যে সিনেমা বানাইতে হইলে আগে আমা একটা প্রোডাকশন টিম দাড় করানো দরকার। এইটাও বুঝতেছিলাম যে, বাংলাদেশের চাইলেই একজন স্বাধীন সিনেমা নির্মাতারে কেউ প্রডিউস করতে চাইবে না। কারণ, তার টাকার কোনও নিশ্চয়তা নাই। এইদিক থেইক্যা আমি ভাগ্যবান। আমার কিছু বন্ধু সব সময়ই আমার ওপর আস্থা রাখছে। এইসব চিন্তা ভাবনা কইরা বন্ধুদের লইয়া নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাই ও টিভি বিজ্ঞাপন বানাইতে থাকি। ঐখান থেকে জমানো কিছু টাকা দিয়াই আমরা লাইভ ফ্রম ঢাকার কাজ শুরু করি।

    প্রশ্ন: আইএমডিবি সূত্র বলতেছে তোমার ছবির বাজেট মাত্র ৮ লাখ টাকা (১০ হাজার ডলার)। এত কম বাজেটে একটা ছবি কীভাবে সম্ভব?
    সাদ: আমি ঠিক তটা কঠিন মনে করি না। আমরা জানি আমাদের ছবির বাজেট কম, সে অনুপাতেই প্রোডাকশন ডিজাইন করছি। এইটা করতে আমাদের কারো কারো বেশ ছাড় দেয়াও লাগছে। মনও হইছে আমি কোনও লোকেশনে স্যুটিং এর অনুমতি পাইনাই, এই সময় কঠিন হইলেও বিকল্প খুঁজে বের করছি। তা হয়ত আগেরটার চাইতে একবারেই অন্যরকম। এর মধ্যেই আমি চাইছি ছবির জন্য সেরা ফ্রেমটা দাঁড় করাইতে ও অভিনেতাদের কাছ থেকে সেরা অভিনয়টা বের করে আনতে। এর পরও আমি স্বীকার করি যে আমার আরও কিছুদিন স্যুটিং করা দরকার ছিলো।

    প্রশ্ন: ছবির শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাজ্জাদের প্রচুর সমস্যা ছিলো, শেষ পর্যন্তও তার জীবন ভালো কিছু হইলো না। তার জীবনে এত ট্রাজেডি কেন?
    সাদ: আমি একটা জটিল জীবনওয়ালা চরিত্র বানাইছি। তারপর চেষ্টা করছি চরিত্রটারে বুঝতেভাবছি, সে কীভাবে এইসব জটিলতা মোকাবেলা করে। আমি বিশ্বাস করি, বিপদে না পরলে সে তা কীভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। ঐখান থেকেই শিখতে হয়।

    প্রশ্ন: ছবিতে কিছু সংঘর্ষের ছবি সত্যি, এইগুলো কোত্থেকে পাইলা?
    সাদ: এইগুলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আর্কাইভ থেকে নেয়া।

    এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কি? প্রচুর মানুষ অন্য কোথাও চলে যেতে চায়, কেনো? তোমার ছবিতে যে দুর্নীতি দেখাইলা, এরচেয়ে বেশী দুর্নীতিই কি কারণ?
    সাদ : আমার মনে হয় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে কথা বলার মানুষ আমি না। এইটা একটা চিরন্তন চিন্তা। একটা ভালো কিছুর আশায় মানুষ নিজের দেশ ছাড়তেছে। ব্যাতিক্রমও আছে। আমরা আসলে আশা খুঁজতে গিয়া মাঝে মাঝে নিজে আশা থেইক্যা দূরে সরে যাই। দুর্নীতি বিষয়ে আমার মনে হয় বিশেষজ্ঞরা বললেই ভালো। তবে আমি কেবল আমার ছবির জন্যে যে দুর্নীতিটা ছিলো তার দিকেই মনযোগ দিয়েছি, এইটা সামগ্রিক দুর্নীতির রূপ না। 

    প্রশ্ন: কী ভেবে ছবিটারে ট্রাজিক বানাইলা?
    সাদ: এইটারে ঠিক ট্রাজিক সিনেমা বলতে চাই না। সত্যি বলতে কি, আমি ঐ রকম চিন্তা করেও কিছু করিনাই। আমি কেবল সাজ্জাদের নৈতিক অবস্থাটার সাথে তার জীনবরক্ষার পদ্ধতিটা কি তা দেখাইতে চাইতেছিলাম। সাজ্জাদের জীবনের ঘটনাগুলো দেখে দর্শকরা কি করে তাও আমি দেখতে চাই।

    প্রশ্ন: মোস্তফা মনোয়ার ছবিতে দুর্দান্ত। তারে এই ছবিতে এই চরিত্রে কেন নিলেন, তার কাছ থেকে অভিনয়টা আদায় করলা কীভাবে? সাধারণত তোমরা শিল্পী কিভাবে নির্বাচন করো?
    সাদ: প্রথমত মোস্তফা মনোয়ারের শরীর কাঠামো এমন, আমি যা মনে মনে খুঁজতেছিলাম। তারপর দেখলাম তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ করার মতো ইউনিক কিছু ধরণ আছে। এই এক্সপ্রেশনগুলো তার অন্যরকম। স্যুটিং শুরুর আগে আমরা চরিত্র নিয়া প্রচুর কথা বলছি। আমাদের যা কথা হইতো বা কোনও পরিকল্পনার সবটা তারে নিয়মিত পাঠাইতাম। এই রকম একটা সময়ে আমরা স্যুট শুরু করলাম। এবং সে নিজেই সাজ্জাদ হয়ে উঠলো। আমার তাকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। আমি কেবল দেখছি দৃশ্যের তীব্রতা ঠিক থাকতেছে কী না।



    প্রশ্ন: গাড়ির দৃশ্যের স্যুট করলেন কেম্নে? সিনেমায় প্রচুর ছোট ছোট ডিটেল সিন, এইটাতো এক্সপেন্সিভ ধরণ!
    সাদ: গাড়ির দৃশ্যটা আমাদের স্যুট করা সবচে কঠিন দৃশ্যগুলোর একটা, বিশেষ করে মোস্তফা মনোয়ারের জন্যও। সে সত্যিকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর মতো চালাইছে ও অভিনয়ও করছে। তুমি যদি কখনো ঢাকায় যাও, তাহলে বুঝবা ঢাকার রাস্তার ট্রাফিক কতটা আনপ্রেডিক্টেবল। আমি আর আমাদের সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন সব সময়ই গাড়ির ব্যাকসিটে বসে দৃশ্য ধারণ করা ও নিয়মিত যেসব ঘটনা ঘটতেছে সেগুলো স্যুট করতে চাইছিলাম।
    আসলে আমি শুরু থেকে ছবির স্যুটিং করিনি। আমি এডিটিং স্টাইল থেকে স্যুট করছি। সাজ্জাদ যা করতেছে তার সবকিছু দেখাতে চাই নি আমি। বা কোনও ইমোশনাল ড্রামাও করতে চাই নাই। এ কারণে ছবিটার গতি ঠিক রাখতে শেষ দিকে প্রচুর পরিমাণে বর্ণনা ও আবেগি বিষয় বাদ দিছি। আমি সাজ্জাদের ধরণটা যেরকম চাইছিলাম ওইটাই ঠিক মনে হইতেছে।

    প্রশ্ন: বাংলাদেশের সিনেমার এই মুহূর্তের অবস্থা কি তবে?
    সাদ: এই মুহূর্তের অবস্থা সম্ভাবনাময়ী। গত কয়েক বছরে আমাদেও কিছু ভালো সিনেমা ছিলো। সামনেও আরও কিছু ভালো ছবি আসতেছে।

    প্রশ্ন: নির্মাতা হওয়ার পেছনে সবচে বেশি প্রভাব কিসের?
    সাদ: মিলান কুন্ডেরার প্রভাব সবচে বেশি। তার উপন্যাস আমারে সিনেমারে একটা শিল্প হিসেবে অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখাইছে।

    প্রশ্ন: সামনে কি করবেন ভাবতেছেন?

    সাদ: নতুন সিনেমার কাজ করতেছি। আশা করি শীঘ্রই শুরু করতে পারবো।

    'কুন্ডেরার উপন্যাস আমার কাছে সিনেমারে একটা শিল্প হিসেবে অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখাইছে'

    at বৃহস্পতিবার, জুন ০১, ২০১৭  |  No comments


    আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ১৯৮৫ সালে জন্ম। সিনেমায় নামার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীতিশাস্ত্র নিয়া পড়াশোনা করছেন। তারপর নিজের প্রোডাকশন হাউস থেইক্যা বানাইছে শর্টফিল্ম, টিভি বিজ্ঞাপন। ২০১৬ সালে তার প্রথম ফিচার ফিল্ম লাইভ ফ্রম ঢাকা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টে প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ২৭ তম সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা নির্মাতা হিসেবে সিলভার স্ক্রিন ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার পায় মোস্তফা মনোয়ার। এশিয়ান ফিল্ম ভল্ট এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয় সাদ এর লগে। এইটা এইখানে নিজের ভাষায় তর্জমা করা গেলো। 


    প্রশ্ন: সিনেমা বানাইতে আসার আগে তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছ, পড়াশোনা শেষে সিনেমা বানানোর দিকে আসার ভুত কোইত্থ্যাইক্যা আইলো?
    সাদ: সত্যি কইতে কি আমি জানিনা। আমি একটুও মনে করতে পারতেছি না কেন আমি আমার পয়লা স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম বা ঠিক কোনটা আমারে উৎসাহ দিছিলো কি না। তবে আমি ছবি দেখতে পছন্দ করতাম। কিন্তু তার মানে এই না, যে আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম যে আমি সিনেমায় কাজ করবো। আমার মনে হয়, সিনেমা আমারে কিছু দিতে পারে, মনে হইলো এইটা জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও হইতে পারে। এইটা ঠিক যেই রকম উত্তর আশা করছেন এই রকম না, অনেক হতাশা থাকলেও সিনেমা নির্মাণ আমাকে জীবন যাপনের একটা পথ বাৎলে দিছে।

    প্রশ্ন: তোমার অলরেডি একটা প্রোডাকশন হাউজ আছে। যেখান থেইকা শর্ট ফিল্ম, টিভি বিজ্ঞাপন বানাও। এইটা সম্পর্কে কি বলবা? মানে তুমি কি এইটা দিয়েই সিনেমার জন্য টাকা যোগার করলা?
    সাদ: আমার মনে হইতেছিলো যে সিনেমা বানাইতে হইলে আগে আমা একটা প্রোডাকশন টিম দাড় করানো দরকার। এইটাও বুঝতেছিলাম যে, বাংলাদেশের চাইলেই একজন স্বাধীন সিনেমা নির্মাতারে কেউ প্রডিউস করতে চাইবে না। কারণ, তার টাকার কোনও নিশ্চয়তা নাই। এইদিক থেইক্যা আমি ভাগ্যবান। আমার কিছু বন্ধু সব সময়ই আমার ওপর আস্থা রাখছে। এইসব চিন্তা ভাবনা কইরা বন্ধুদের লইয়া নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাই ও টিভি বিজ্ঞাপন বানাইতে থাকি। ঐখান থেকে জমানো কিছু টাকা দিয়াই আমরা লাইভ ফ্রম ঢাকার কাজ শুরু করি।

    প্রশ্ন: আইএমডিবি সূত্র বলতেছে তোমার ছবির বাজেট মাত্র ৮ লাখ টাকা (১০ হাজার ডলার)। এত কম বাজেটে একটা ছবি কীভাবে সম্ভব?
    সাদ: আমি ঠিক তটা কঠিন মনে করি না। আমরা জানি আমাদের ছবির বাজেট কম, সে অনুপাতেই প্রোডাকশন ডিজাইন করছি। এইটা করতে আমাদের কারো কারো বেশ ছাড় দেয়াও লাগছে। মনও হইছে আমি কোনও লোকেশনে স্যুটিং এর অনুমতি পাইনাই, এই সময় কঠিন হইলেও বিকল্প খুঁজে বের করছি। তা হয়ত আগেরটার চাইতে একবারেই অন্যরকম। এর মধ্যেই আমি চাইছি ছবির জন্য সেরা ফ্রেমটা দাঁড় করাইতে ও অভিনেতাদের কাছ থেকে সেরা অভিনয়টা বের করে আনতে। এর পরও আমি স্বীকার করি যে আমার আরও কিছুদিন স্যুটিং করা দরকার ছিলো।

    প্রশ্ন: ছবির শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাজ্জাদের প্রচুর সমস্যা ছিলো, শেষ পর্যন্তও তার জীবন ভালো কিছু হইলো না। তার জীবনে এত ট্রাজেডি কেন?
    সাদ: আমি একটা জটিল জীবনওয়ালা চরিত্র বানাইছি। তারপর চেষ্টা করছি চরিত্রটারে বুঝতেভাবছি, সে কীভাবে এইসব জটিলতা মোকাবেলা করে। আমি বিশ্বাস করি, বিপদে না পরলে সে তা কীভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। ঐখান থেকেই শিখতে হয়।

    প্রশ্ন: ছবিতে কিছু সংঘর্ষের ছবি সত্যি, এইগুলো কোত্থেকে পাইলা?
    সাদ: এইগুলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আর্কাইভ থেকে নেয়া।

    এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কি? প্রচুর মানুষ অন্য কোথাও চলে যেতে চায়, কেনো? তোমার ছবিতে যে দুর্নীতি দেখাইলা, এরচেয়ে বেশী দুর্নীতিই কি কারণ?
    সাদ : আমার মনে হয় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে কথা বলার মানুষ আমি না। এইটা একটা চিরন্তন চিন্তা। একটা ভালো কিছুর আশায় মানুষ নিজের দেশ ছাড়তেছে। ব্যাতিক্রমও আছে। আমরা আসলে আশা খুঁজতে গিয়া মাঝে মাঝে নিজে আশা থেইক্যা দূরে সরে যাই। দুর্নীতি বিষয়ে আমার মনে হয় বিশেষজ্ঞরা বললেই ভালো। তবে আমি কেবল আমার ছবির জন্যে যে দুর্নীতিটা ছিলো তার দিকেই মনযোগ দিয়েছি, এইটা সামগ্রিক দুর্নীতির রূপ না। 

    প্রশ্ন: কী ভেবে ছবিটারে ট্রাজিক বানাইলা?
    সাদ: এইটারে ঠিক ট্রাজিক সিনেমা বলতে চাই না। সত্যি বলতে কি, আমি ঐ রকম চিন্তা করেও কিছু করিনাই। আমি কেবল সাজ্জাদের নৈতিক অবস্থাটার সাথে তার জীনবরক্ষার পদ্ধতিটা কি তা দেখাইতে চাইতেছিলাম। সাজ্জাদের জীবনের ঘটনাগুলো দেখে দর্শকরা কি করে তাও আমি দেখতে চাই।

    প্রশ্ন: মোস্তফা মনোয়ার ছবিতে দুর্দান্ত। তারে এই ছবিতে এই চরিত্রে কেন নিলেন, তার কাছ থেকে অভিনয়টা আদায় করলা কীভাবে? সাধারণত তোমরা শিল্পী কিভাবে নির্বাচন করো?
    সাদ: প্রথমত মোস্তফা মনোয়ারের শরীর কাঠামো এমন, আমি যা মনে মনে খুঁজতেছিলাম। তারপর দেখলাম তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ করার মতো ইউনিক কিছু ধরণ আছে। এই এক্সপ্রেশনগুলো তার অন্যরকম। স্যুটিং শুরুর আগে আমরা চরিত্র নিয়া প্রচুর কথা বলছি। আমাদের যা কথা হইতো বা কোনও পরিকল্পনার সবটা তারে নিয়মিত পাঠাইতাম। এই রকম একটা সময়ে আমরা স্যুট শুরু করলাম। এবং সে নিজেই সাজ্জাদ হয়ে উঠলো। আমার তাকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। আমি কেবল দেখছি দৃশ্যের তীব্রতা ঠিক থাকতেছে কী না।



    প্রশ্ন: গাড়ির দৃশ্যের স্যুট করলেন কেম্নে? সিনেমায় প্রচুর ছোট ছোট ডিটেল সিন, এইটাতো এক্সপেন্সিভ ধরণ!
    সাদ: গাড়ির দৃশ্যটা আমাদের স্যুট করা সবচে কঠিন দৃশ্যগুলোর একটা, বিশেষ করে মোস্তফা মনোয়ারের জন্যও। সে সত্যিকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর মতো চালাইছে ও অভিনয়ও করছে। তুমি যদি কখনো ঢাকায় যাও, তাহলে বুঝবা ঢাকার রাস্তার ট্রাফিক কতটা আনপ্রেডিক্টেবল। আমি আর আমাদের সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন সব সময়ই গাড়ির ব্যাকসিটে বসে দৃশ্য ধারণ করা ও নিয়মিত যেসব ঘটনা ঘটতেছে সেগুলো স্যুট করতে চাইছিলাম।
    আসলে আমি শুরু থেকে ছবির স্যুটিং করিনি। আমি এডিটিং স্টাইল থেকে স্যুট করছি। সাজ্জাদ যা করতেছে তার সবকিছু দেখাতে চাই নি আমি। বা কোনও ইমোশনাল ড্রামাও করতে চাই নাই। এ কারণে ছবিটার গতি ঠিক রাখতে শেষ দিকে প্রচুর পরিমাণে বর্ণনা ও আবেগি বিষয় বাদ দিছি। আমি সাজ্জাদের ধরণটা যেরকম চাইছিলাম ওইটাই ঠিক মনে হইতেছে।

    প্রশ্ন: বাংলাদেশের সিনেমার এই মুহূর্তের অবস্থা কি তবে?
    সাদ: এই মুহূর্তের অবস্থা সম্ভাবনাময়ী। গত কয়েক বছরে আমাদেও কিছু ভালো সিনেমা ছিলো। সামনেও আরও কিছু ভালো ছবি আসতেছে।

    প্রশ্ন: নির্মাতা হওয়ার পেছনে সবচে বেশি প্রভাব কিসের?
    সাদ: মিলান কুন্ডেরার প্রভাব সবচে বেশি। তার উপন্যাস আমারে সিনেমারে একটা শিল্প হিসেবে অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখাইছে।

    প্রশ্ন: সামনে কি করবেন ভাবতেছেন?

    সাদ: নতুন সিনেমার কাজ করতেছি। আশা করি শীঘ্রই শুরু করতে পারবো।

    Read More

    রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬



    গত ২২ জানুয়ারি ছিলো প্রিয় ব্যান্ড মেঘদলের এক যুগ পূর্তি। সেই দিনের বারো বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাইছিলো এক বাংলা ব্যান্ড। যার নাম মেঘদল। তো প্রিয় ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠার যুগপূর্তিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে নিচে আইসা সাইয়েদ জামিল কমেন্ট করে “‘মেঘদল-টা কী জিনিসরে কমল? আমি কোনও উত্তর দেই নাই। কারণ, আমার ধারণা জামিল খুব ভালো করেই জানে এইটা কি জিনিস। তাই হয়তো তার অন্য কোনও চিন্তা আছে প্রশ্নের পেছনে। তাই আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য একটু সময় চাইতেছিলাম। চাইতেছিলাম, একটু ডিটেইলে বলি। এই লেখা আসলে সাইয়েদ জামিলকে লেখা সেই উত্তর। যা আমি আরও বহু আগেই বলতে চাইছিলাম একা একা। নিজের জন্য, নিজের কাছে।


    ফ্ল্যাশব্যাক
    মেঘদল কী জিনিস এই কথা বলার জন্য আমাকে একটু পেছনে তাকাতে হয়। সেইটা ২০০৬ সালের কথা। আমি তখন পুরোদমে ছাত্র ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা কমিটিতে রাজনীতি করি। সেই সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ফেব্রুয়ারিতে। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে ময়মনসিংহ থেকে সদলবলে ঢাকায় আসলাম। উদ্বোধনী দিনে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছাত্র ইউনিয়নের আমন্ত্রিত ব্যান্ড চিৎকার আর মেঘদল। দুইটা ব্যান্ডের গান আমি সেবারই প্রথম শুনি। চিৎকারের কয়েকটা চমৎকার গান শোনার পর (যার মাঝে একটা ছিলো হাট্টিমাটিম টিম লইয়া গবেষণা চালাইছে) মেঘদল মঞ্চে দাঁড়ায়। সেই আমার মেঘদলকে চেনার শুরু। যা এখনও ধারাবাহিক। সেইবার মেঘদল ঔম, ক্রুসেডসহ চার-কি পাঁচটি গান গায়।  বায়োস্কোপের নেশা আমার যেমন ছাড়ে না, তেমনি চেপে বসে মেঘদলের গানের নেশাও। সম্মেলন শেষে ময়মনসিংহে গিয়ে দেখি মেঘদলের অডিও অ্যালবাম কেউ সেখানে নেয় নাই। নিবেই কিভাবে? তারা তো আর জনপ্রিয় ব্যান্ড না। কিন্তু মেঘদলের গান এইভাবে না শুনে কেমনে দিন কাটাই? তাই ঢাকা থেকে মেঘদলের অডিও সিডি কিনে ময়মনসিংহে নেয়া হলো। বন্ধুরা যেই কয়টা কপির চেষ্টা করছিলাম, ততগুলো পাওয়া গেলো না। পাওয়া গেলো মাত্র এক কপি। আর তাই পালা করে কম্পিউটারে কপি করা। তারপর সবার মুখস্থ। ময়মনসিংহে পরিচিত না হলেও মেঘদল ঢাকায় মোটামোটি পপুলার। হুট করে একদিন দেখি অতনু (অতনু তিয়াস) তাদের নিয়া ইত্তেফাকে একটা ফিচারও লিখলো। বাহ্ চমৎকার তো! আর কই যায়। সে বছরই আমি রাজনীতি থেকে সরাসরি সরে আসি। কিন্তু মেঘদলের সাথে সম্পর্কটা ছাড়া হয় নি। বরং বেড়েছেই বলা যায়। এইবার নিজেকে প্রশ্ন করি। আসলেই কি বেড়েছে? যদি বেড়েই থাকে তবে বলো দেখি, মেঘদল কি?


    এই প্রশ্নের খোঁজা কি মূখ্য বিষয় কিনা জানিনা। তবে এ জানি মেঘদল আমাদের রোদের চিঠি, অথবা বনসাই বনের মালি। কারণ, এই যে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে বেদনারহিত অনুভূতির দেয়াল এর সীমানা কোনটা আমরা জানি না। জানি কখনও উসাইন বোল্টের মতো, কখনো ম্যারাথনের প্রতিযোগিদের মতো দৌড়াইতেছি কেবল। এই দৌড়ের মধ্যে চুপচাপ যে হাওয়া বাতাস আসে, মনে সাহস আর অনুপ্রেরণাও যোগায় সেইটা মেঘদলের গান।

    রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঐদিন ঐ মঞ্চে যেই লাইনআপ ছিলো এখন বোধহয় সেই লাইনআপ হুবহু নাই। সেদিন নগরের অতিথি আমি ভার্সিটির রাস্তায় নিজের জুতা পশ্চাদেশের নিচে দিয়া বসে পড়ছিলাম। গান শুনছিলাম সম্ভবত চারটা কি পাঁচটা। তার মধ্যে ঔম, চতুর্দিকে, ক্রুসেড, ব্যবচ্ছেদ গানগুলো ছিলো মনে করতে পারি।

    তারপর রিপিটেশনের কালে, একই গান বারবার বারবার শুনছি ঔম। কেন শুনছি এই প্রশ্ন করলে এখনো চুপ হয়ে যাই। মনে হয়, কার কাছে দিবো এই উত্তর? সে কি গান শুনছিলো না সুর? নাকি কিছুটা হাওয়ায় ভেসে আসা একটা চড়কির মতো কথাবার্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল? আমার নিজের কাছে প্রশ্নগুলোরই উত্তর মেলে না। অন্যকে কিভাবে উত্তর দেই!!!

    ঔম গানটা আমি নানান ধরনে মানুষকে শোনাইছি। একবার এক মুর্শীদি ভক্ত কবিরাজরে শুনাইছিলাম। গান  শুনে তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরলেন। বললেন, তুমি এমন সুন্দর গান কই পাইলা? তার চোখে মানুষের মুক্তির যে আনন্দ সেই আনন্দ দেখছিলাম। সত্যি বলছি, সেই মুক্তির আনন্দ অনেক দিন কারো চোখে দেখি না। সব পরাজিত যোদ্ধা দেখি। চোখের সামনে সব ক্লান্ত বিমর্ষ আর বিদঘুটে অন্ধকারময় খিলখিল হাসি। ঐদিন, ঐ মুর্শীদি ভক্ত তার ভাবনার ধর্ম অধর্মের বিশাল লেকচার শুনাইছিলো। তর্ক হইছিলো তার সাথে, হইছিলো আলোচনা। ভাবনার বিষয় বিস্তৃত হয়ে আর গানে ছিলো না। ছিলো ধর্ম আর মানুষে। দীর্ঘ সেই সংলাপ শেষে আমরা যখন সমাপ্তির পর্দা টানি, তখন আমরা একমত হইছিলাম এই চিন্তায় যে, মানুষ যে এত ধর্ম-ধর্ম করে-ধর্মেরও উচিত কিছু মানুষ-মানুষ করা। কিন্তু ঐ ধর্মই তো বায়বিয়। আমরা কেমনে তার ছায়া মাড়াই? আমাদেও দুনিয়ার হাওয়া বাতাসে বাড়তে বাড়তে আমাদের চাইতে বড় হয়ে যায় ধর্ম। কেমন বড়? তার কোনও আকার আয়তনের কথা আমরা বলতেই পারি না। তারে না যায় ধরা, না যায় ছোঁয়া।

    এবার অন্য সুরে তাকাই, অন্য কথায়-সঙ্গীতে। আসলেই ধর্ম বলে কি কিছু আছে কি না, সেই প্রশ্নের চাইতে তখন আমাদের চিন্তা খেলা করে জগৎ সংসার নিয়ে। মনে প্রশ্ন জাগে মানুষের কজন ভগবান, কজনে ভাগ্য লেখে- কজনে জীবন সামলান? এই প্রশ্ন আর উত্তরের খেলা খেলতে গিয়ে আমরা হাওয়ার মতো অদৃশ্য কিছু উত্তরও তাদের কাছ থেকে পাই। তারা বলে দিয়ে যায়, আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান, মানুষ ধ্বংসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন। কিন্তু এই উত্তরে আমাদের স্বস্তি মেলে না। আমরা অস্বস্তি নিয়ে দৌড়ে উঠে বসি নিজ নিজ গন্তব্যের লোকাল বাসে। ফেরা আর না ফেরার এক অস্পৃশ্য প্রতিবন্ধকতাও আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে পড়ে। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি পায় আমাদের, ভুলে যায় বিষাদময় রাত্রীদিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে। আধো ঘুম আধো জাগ্রত জগত থেকে অন্য এক জগতের দিকে হাঁটি আর তারাও কিনা বলে আমারই কথা, আমাদেরই কথা-
    আমি হেঁটে যাই মেঘের কাছে
    আমি হেঁটে যাই
    হেঁটে যাই
    প্রশ্বাসে ছুঁয়েছি আকাশ
    দুঃখ ছুঁয়ে যায় বাতাসে বাতাসে
    আমি হেঁটে যাই
    আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিও তুমি মেঘ...
    এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরে আমাদের। গলা ভিজে আসে পাপবোধে। বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যাই। মনে পরে সুদূরে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব। কে সেই শান্তির দূত? যে অবয়বের চেয়ে বেশিকিছু নয়, অথবা নেই তারে ছুঁয়ে যাওয়ার কোনও ছুতো। কেবল বুকের ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠি... ভালোবাসা হইয়ো তুমি পরজনমে। কিন্তু তা হয় না। বরঙ ডানা মেলে অন্য এক ভূবনে, উড়ে যায় নিশিপাখির মতো, খুব করে ভুলে যাওয়া এক পাখির ডানার মতো উড়ে যায়। হারিয়ে যায়, বিভ্রান্ত পথিকের মতো অচেনা শহরে। সেই শহর কোথায়? কোন পথে ছুটলে সেই পথের সন্ধান মিলবে? আদৌ মিলবে কি না, তা জানা নেই। থাকবে কি করে? নাগরিক কবিয়ালকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকেই হারিয়েছে ফেলেছি চেনা অচেনা আলো আধারে, চলতি পথে কোনও বাসের ভীড়ে। অথচ প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের শৈশব কান্না করে নগরীর নোনা ধরা দেয়ালে। দূরে কোথাও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, আকাশে আলো ছায়ার খেলায় ভুলে যাই টানাপোড়েনের আলু-বেগুনের দাম আর লোকাল বাসের ভাড়া। মনে মনে খেলা করে মৃত বিপ্লবের আত্মা-কান্নার বৃষ্টি নামে শহরে আর-
    আমার শহর খুব সহজে একলা পাখির মতো ভিজতে থাকে
    কেউ জানে না কোন তীব্র শ্লোগান, মুখর হতে এই শহরে
    জানি, শ্লোগান মুখর সময়ের গল্প আমাদের ভুরি-ভুরি। কিন্তু এই যে বন্ধ্যাকাল, ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ নেই। নেই মানুষের ডাকে মানুষের সাড়া দেয়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি মানবিকতা বোধের গোপন চিঠি। এমন সময়ে যারা সমাজে সবচেয়ে বেশী দায় বোধ করে, প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী তারাই। যদিও সমাজে তার কর্মের প্রভাব আসে খুব ধীরে, কিন্তু স্থায়ি হয় সেইটাই। এই দায়বোধটার অনেকটাই গ্রহণ করে মেঘদল। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাষায় তাদের চেতনার প্রকাশটাই অনেক সময় হয়ে উঠে সমাজের বেদনার ভাষা। এমন পরিস্থিতির কথাও কিন্তু তারা তাদের গানেই বলে দিয়েছে আরও বহু আগে।
    অস্থিরতায়, নিমগ্নতায় পুড়ছে স্বদেশ পুড়ছে সবাই
    তবু রুখে দাঁড়াই আমরা!
    ঘুরে দাঁড়াই আমরা!! ফিরে দাঁড়াই!!!
    এই হলো শিল্পীর দায়বোধ। যা এড়িয়ে গেলে তাকে আর শিল্পী ভাবতে পারি না আমি। আসলে আমি ভাবতে চাইও না। এই বিষয় নিয়ে অনেকের সাথে অনেক তর্ক আর আলোচনা হয়-হয়েছে। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র বদলায়নি। হয়তো মেঘদলও আমার মতো ভাবে না, কিন্তু আমি তাদের কাজে নিজের ভাবনার ছায়া পাই। যা তাদেরকে নিজের মতো ভাবতে সহায়তা করে।

    মেঘদল আসলে গোপন এক আশ্রয়ের নাম। যখন নিজের সাথে নিজের লড়াই করার প্রয়োজন, তখন অন্তর্গত অনুপ্রেরণা হিসেবে মেঘদল আসে। এই আশ্রয়ের অনুভূতি প্রকাশে বোদলেয়ারের আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই; তাই সেই ভাষাতেই বলি-
    আমি ভালোবাসি মেঘ... চলিষ্ণু মেঘ... ঐ উচুতে... ঐ উচুতে

    আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!

    মেঘদল আমাদের রোদের চিঠি

    at রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬  |  No comments



    গত ২২ জানুয়ারি ছিলো প্রিয় ব্যান্ড মেঘদলের এক যুগ পূর্তি। সেই দিনের বারো বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাইছিলো এক বাংলা ব্যান্ড। যার নাম মেঘদল। তো প্রিয় ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠার যুগপূর্তিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে নিচে আইসা সাইয়েদ জামিল কমেন্ট করে “‘মেঘদল-টা কী জিনিসরে কমল? আমি কোনও উত্তর দেই নাই। কারণ, আমার ধারণা জামিল খুব ভালো করেই জানে এইটা কি জিনিস। তাই হয়তো তার অন্য কোনও চিন্তা আছে প্রশ্নের পেছনে। তাই আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য একটু সময় চাইতেছিলাম। চাইতেছিলাম, একটু ডিটেইলে বলি। এই লেখা আসলে সাইয়েদ জামিলকে লেখা সেই উত্তর। যা আমি আরও বহু আগেই বলতে চাইছিলাম একা একা। নিজের জন্য, নিজের কাছে।


    ফ্ল্যাশব্যাক
    মেঘদল কী জিনিস এই কথা বলার জন্য আমাকে একটু পেছনে তাকাতে হয়। সেইটা ২০০৬ সালের কথা। আমি তখন পুরোদমে ছাত্র ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা কমিটিতে রাজনীতি করি। সেই সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ফেব্রুয়ারিতে। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে ময়মনসিংহ থেকে সদলবলে ঢাকায় আসলাম। উদ্বোধনী দিনে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছাত্র ইউনিয়নের আমন্ত্রিত ব্যান্ড চিৎকার আর মেঘদল। দুইটা ব্যান্ডের গান আমি সেবারই প্রথম শুনি। চিৎকারের কয়েকটা চমৎকার গান শোনার পর (যার মাঝে একটা ছিলো হাট্টিমাটিম টিম লইয়া গবেষণা চালাইছে) মেঘদল মঞ্চে দাঁড়ায়। সেই আমার মেঘদলকে চেনার শুরু। যা এখনও ধারাবাহিক। সেইবার মেঘদল ঔম, ক্রুসেডসহ চার-কি পাঁচটি গান গায়।  বায়োস্কোপের নেশা আমার যেমন ছাড়ে না, তেমনি চেপে বসে মেঘদলের গানের নেশাও। সম্মেলন শেষে ময়মনসিংহে গিয়ে দেখি মেঘদলের অডিও অ্যালবাম কেউ সেখানে নেয় নাই। নিবেই কিভাবে? তারা তো আর জনপ্রিয় ব্যান্ড না। কিন্তু মেঘদলের গান এইভাবে না শুনে কেমনে দিন কাটাই? তাই ঢাকা থেকে মেঘদলের অডিও সিডি কিনে ময়মনসিংহে নেয়া হলো। বন্ধুরা যেই কয়টা কপির চেষ্টা করছিলাম, ততগুলো পাওয়া গেলো না। পাওয়া গেলো মাত্র এক কপি। আর তাই পালা করে কম্পিউটারে কপি করা। তারপর সবার মুখস্থ। ময়মনসিংহে পরিচিত না হলেও মেঘদল ঢাকায় মোটামোটি পপুলার। হুট করে একদিন দেখি অতনু (অতনু তিয়াস) তাদের নিয়া ইত্তেফাকে একটা ফিচারও লিখলো। বাহ্ চমৎকার তো! আর কই যায়। সে বছরই আমি রাজনীতি থেকে সরাসরি সরে আসি। কিন্তু মেঘদলের সাথে সম্পর্কটা ছাড়া হয় নি। বরং বেড়েছেই বলা যায়। এইবার নিজেকে প্রশ্ন করি। আসলেই কি বেড়েছে? যদি বেড়েই থাকে তবে বলো দেখি, মেঘদল কি?


    এই প্রশ্নের খোঁজা কি মূখ্য বিষয় কিনা জানিনা। তবে এ জানি মেঘদল আমাদের রোদের চিঠি, অথবা বনসাই বনের মালি। কারণ, এই যে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে বেদনারহিত অনুভূতির দেয়াল এর সীমানা কোনটা আমরা জানি না। জানি কখনও উসাইন বোল্টের মতো, কখনো ম্যারাথনের প্রতিযোগিদের মতো দৌড়াইতেছি কেবল। এই দৌড়ের মধ্যে চুপচাপ যে হাওয়া বাতাস আসে, মনে সাহস আর অনুপ্রেরণাও যোগায় সেইটা মেঘদলের গান।

    রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঐদিন ঐ মঞ্চে যেই লাইনআপ ছিলো এখন বোধহয় সেই লাইনআপ হুবহু নাই। সেদিন নগরের অতিথি আমি ভার্সিটির রাস্তায় নিজের জুতা পশ্চাদেশের নিচে দিয়া বসে পড়ছিলাম। গান শুনছিলাম সম্ভবত চারটা কি পাঁচটা। তার মধ্যে ঔম, চতুর্দিকে, ক্রুসেড, ব্যবচ্ছেদ গানগুলো ছিলো মনে করতে পারি।

    তারপর রিপিটেশনের কালে, একই গান বারবার বারবার শুনছি ঔম। কেন শুনছি এই প্রশ্ন করলে এখনো চুপ হয়ে যাই। মনে হয়, কার কাছে দিবো এই উত্তর? সে কি গান শুনছিলো না সুর? নাকি কিছুটা হাওয়ায় ভেসে আসা একটা চড়কির মতো কথাবার্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল? আমার নিজের কাছে প্রশ্নগুলোরই উত্তর মেলে না। অন্যকে কিভাবে উত্তর দেই!!!

    ঔম গানটা আমি নানান ধরনে মানুষকে শোনাইছি। একবার এক মুর্শীদি ভক্ত কবিরাজরে শুনাইছিলাম। গান  শুনে তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরলেন। বললেন, তুমি এমন সুন্দর গান কই পাইলা? তার চোখে মানুষের মুক্তির যে আনন্দ সেই আনন্দ দেখছিলাম। সত্যি বলছি, সেই মুক্তির আনন্দ অনেক দিন কারো চোখে দেখি না। সব পরাজিত যোদ্ধা দেখি। চোখের সামনে সব ক্লান্ত বিমর্ষ আর বিদঘুটে অন্ধকারময় খিলখিল হাসি। ঐদিন, ঐ মুর্শীদি ভক্ত তার ভাবনার ধর্ম অধর্মের বিশাল লেকচার শুনাইছিলো। তর্ক হইছিলো তার সাথে, হইছিলো আলোচনা। ভাবনার বিষয় বিস্তৃত হয়ে আর গানে ছিলো না। ছিলো ধর্ম আর মানুষে। দীর্ঘ সেই সংলাপ শেষে আমরা যখন সমাপ্তির পর্দা টানি, তখন আমরা একমত হইছিলাম এই চিন্তায় যে, মানুষ যে এত ধর্ম-ধর্ম করে-ধর্মেরও উচিত কিছু মানুষ-মানুষ করা। কিন্তু ঐ ধর্মই তো বায়বিয়। আমরা কেমনে তার ছায়া মাড়াই? আমাদেও দুনিয়ার হাওয়া বাতাসে বাড়তে বাড়তে আমাদের চাইতে বড় হয়ে যায় ধর্ম। কেমন বড়? তার কোনও আকার আয়তনের কথা আমরা বলতেই পারি না। তারে না যায় ধরা, না যায় ছোঁয়া।

    এবার অন্য সুরে তাকাই, অন্য কথায়-সঙ্গীতে। আসলেই ধর্ম বলে কি কিছু আছে কি না, সেই প্রশ্নের চাইতে তখন আমাদের চিন্তা খেলা করে জগৎ সংসার নিয়ে। মনে প্রশ্ন জাগে মানুষের কজন ভগবান, কজনে ভাগ্য লেখে- কজনে জীবন সামলান? এই প্রশ্ন আর উত্তরের খেলা খেলতে গিয়ে আমরা হাওয়ার মতো অদৃশ্য কিছু উত্তরও তাদের কাছ থেকে পাই। তারা বলে দিয়ে যায়, আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান, মানুষ ধ্বংসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন। কিন্তু এই উত্তরে আমাদের স্বস্তি মেলে না। আমরা অস্বস্তি নিয়ে দৌড়ে উঠে বসি নিজ নিজ গন্তব্যের লোকাল বাসে। ফেরা আর না ফেরার এক অস্পৃশ্য প্রতিবন্ধকতাও আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে পড়ে। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি পায় আমাদের, ভুলে যায় বিষাদময় রাত্রীদিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে। আধো ঘুম আধো জাগ্রত জগত থেকে অন্য এক জগতের দিকে হাঁটি আর তারাও কিনা বলে আমারই কথা, আমাদেরই কথা-
    আমি হেঁটে যাই মেঘের কাছে
    আমি হেঁটে যাই
    হেঁটে যাই
    প্রশ্বাসে ছুঁয়েছি আকাশ
    দুঃখ ছুঁয়ে যায় বাতাসে বাতাসে
    আমি হেঁটে যাই
    আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিও তুমি মেঘ...
    এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরে আমাদের। গলা ভিজে আসে পাপবোধে। বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যাই। মনে পরে সুদূরে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব। কে সেই শান্তির দূত? যে অবয়বের চেয়ে বেশিকিছু নয়, অথবা নেই তারে ছুঁয়ে যাওয়ার কোনও ছুতো। কেবল বুকের ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠি... ভালোবাসা হইয়ো তুমি পরজনমে। কিন্তু তা হয় না। বরঙ ডানা মেলে অন্য এক ভূবনে, উড়ে যায় নিশিপাখির মতো, খুব করে ভুলে যাওয়া এক পাখির ডানার মতো উড়ে যায়। হারিয়ে যায়, বিভ্রান্ত পথিকের মতো অচেনা শহরে। সেই শহর কোথায়? কোন পথে ছুটলে সেই পথের সন্ধান মিলবে? আদৌ মিলবে কি না, তা জানা নেই। থাকবে কি করে? নাগরিক কবিয়ালকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকেই হারিয়েছে ফেলেছি চেনা অচেনা আলো আধারে, চলতি পথে কোনও বাসের ভীড়ে। অথচ প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের শৈশব কান্না করে নগরীর নোনা ধরা দেয়ালে। দূরে কোথাও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, আকাশে আলো ছায়ার খেলায় ভুলে যাই টানাপোড়েনের আলু-বেগুনের দাম আর লোকাল বাসের ভাড়া। মনে মনে খেলা করে মৃত বিপ্লবের আত্মা-কান্নার বৃষ্টি নামে শহরে আর-
    আমার শহর খুব সহজে একলা পাখির মতো ভিজতে থাকে
    কেউ জানে না কোন তীব্র শ্লোগান, মুখর হতে এই শহরে
    জানি, শ্লোগান মুখর সময়ের গল্প আমাদের ভুরি-ভুরি। কিন্তু এই যে বন্ধ্যাকাল, ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ নেই। নেই মানুষের ডাকে মানুষের সাড়া দেয়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি মানবিকতা বোধের গোপন চিঠি। এমন সময়ে যারা সমাজে সবচেয়ে বেশী দায় বোধ করে, প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী তারাই। যদিও সমাজে তার কর্মের প্রভাব আসে খুব ধীরে, কিন্তু স্থায়ি হয় সেইটাই। এই দায়বোধটার অনেকটাই গ্রহণ করে মেঘদল। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাষায় তাদের চেতনার প্রকাশটাই অনেক সময় হয়ে উঠে সমাজের বেদনার ভাষা। এমন পরিস্থিতির কথাও কিন্তু তারা তাদের গানেই বলে দিয়েছে আরও বহু আগে।
    অস্থিরতায়, নিমগ্নতায় পুড়ছে স্বদেশ পুড়ছে সবাই
    তবু রুখে দাঁড়াই আমরা!
    ঘুরে দাঁড়াই আমরা!! ফিরে দাঁড়াই!!!
    এই হলো শিল্পীর দায়বোধ। যা এড়িয়ে গেলে তাকে আর শিল্পী ভাবতে পারি না আমি। আসলে আমি ভাবতে চাইও না। এই বিষয় নিয়ে অনেকের সাথে অনেক তর্ক আর আলোচনা হয়-হয়েছে। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র বদলায়নি। হয়তো মেঘদলও আমার মতো ভাবে না, কিন্তু আমি তাদের কাজে নিজের ভাবনার ছায়া পাই। যা তাদেরকে নিজের মতো ভাবতে সহায়তা করে।

    মেঘদল আসলে গোপন এক আশ্রয়ের নাম। যখন নিজের সাথে নিজের লড়াই করার প্রয়োজন, তখন অন্তর্গত অনুপ্রেরণা হিসেবে মেঘদল আসে। এই আশ্রয়ের অনুভূতি প্রকাশে বোদলেয়ারের আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই; তাই সেই ভাষাতেই বলি-
    আমি ভালোবাসি মেঘ... চলিষ্ণু মেঘ... ঐ উচুতে... ঐ উচুতে

    আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!

    Read More

    রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬



    এরপর আর মেঘদল, মহিনের ঘোড়াগুলি, পিংক ফ্লয়েড, রবিশংকর, ইনারিতু কিছুই ভাল্লাগেনা। এমন একটা মুহূর্ত অনেকটা হ্যাংআউটের মতো। অথচ নেশা টেশা কিচ্ছু করিনাই। কেন ভাল্লাগেনা ভেবে কোনও উত্তর না পাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেলো। মন ভালো করতে হবে। তার জন্য চাই বিশেষ কিছু। কিন্তু বিশেষ কিছুটা কী? উত্তর জানা নাই। এইসবের সাথে আবার যোগ হয় গুলশান হামলা, শোলাকিয়া ঈদের জামাত, নামাজ না পড়া খারাপ মানুষ, ব্যাচেলর বিড়ম্বনা! সবকিছু মিলে একটা হচপচ অবস্থা। এই যেমন দুপুর দুইটার সংবাদের রানডাউন (লাইনআপ), হেডলাইন, এডিটর সব রেডি কিন্তু লিড আইটেমের স্ক্রিপ্ট নাই, রিপোর্টার নাই, ফুটেজ নাই অবস্থা। এই অবস্থা থেকেও যেমন নিউজরুম সংকট থেকে উৎরায় তেমন আমিও উৎরাইলাম। খালিয়াজুরির সফল ট্যুরের পর মোটামোটি একটা দল হইছিলো আমগো। যারা বিরিশিরির মতো দুর্বল পর্যটন এলাকাতেও গেছিলাম দল বেধে। তাদের স্মরণাপন্ন হইলাম। প্রত্যেকরে ফেসবুকে নক করে বলা গেলো, চল দ্বীপান্তর হই। বলতেই এক একটা হই হই করে রাজী। আরে কি সব্বনাশ! আমিতো ভাবছিলাম তরা কেউ যাবি না, আমি একলাই দাও মেরে আসবো। এখন কি হবে? যা থাকে কপালে। কপালের নাম গোপাল, আমার কপালের নাম রাজ কপাল। এই বলে সবাইরে নিয়েই যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
    হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের মাঝের মেঘনা-বঙ্গোপসাগর চ্যানেলে এ
    সেই অনুপাতে দিন তারিখ ঠিক হইলো। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না, ভগবান ইচ্ছা ঠাকুরনেরও তো চাইতে হবে। এই অবস্থায় দিন যত আগায় এক একজন করে উইকেট পড়তে থাকে। এগারোজনের মধ্যে ৬ উইকেট শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত ঝড়ে যায়। কী আর করা! সিক্স-এ সাইড টুর্নামেন্টও হইলো না, অগত্যা ৫ জনই সই। একা যাওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বড় দল, তাও বিসর্জন দিয়ে ছোট দল নিয়েই একদিন বৈকালে উইঠ্যা পড়লাম হাতিয়াগামী এমভি ফারহান-৪ এ। বাহ্‌, সদরঘাট থেকে ইয়া বড় একটা লঞ্চ দিব্বি পানিতে ভাসতে ভাসতে আমাদের নিয়ে চললো। যাইতে শুরু করলাম। বুড়িগঙ্গা পাড় হয়ে শীতলক্ষায় পড়ার পর নদীর পাড় ঘেষে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করলো। মালায়ালাম ছবির গ্রামগুলোর মতো শীতলক্ষার পাড় ধরে চমৎকার কিছু জায়গা দেখলাম। মনে হলো নদী থেকে নয়, একবার কেবল হাঁটার জন্য সেখানে আসা উচিত। তো এইরকম চারপাশ আমরা দ্রুত অতিক্রম করতেছিলাম। আর দ্রুতই সন্ধ্যাও নেমে এলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চেয়ার টেনে লঞ্চের কেবিনের সামনে বসে পড়লাম আমরা। আড্ডা দিতে। আড্ডায় সবার আগে উঠে এলো এক সময় ঢাকা শহরের ভিনদেশী পর্যটকদের কোনও আয়োজন হলে সন্ধ্যাটা বুড়িগঙ্গার নৌবিহার দিয়ে শেষ হইতো। এখন হয় পানশালায়। এইভাবে বদলাইতেছে জীবন ও সমাজ। হইতেছি আধুনিক ও ডিজিটাল। 
    এইটা সফরের আইকনিক ছবি। নিঝুম দ্বীপ বিচে।

     সময় গড়িয়ে আমাদের বহন করা লঞ্চ মেঘনায় গড়ায়। চাঁদপুর লঞ্চঘাট দূর থেকে দেখি। শহরে নদীর পাড় ধরে সার বদ্ধ আলোর দল। আর মাঝ নদীতে মাছ ধরা ইলিশের নৌকায়ও। মুগ্ধতা নিয়ে সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফাকে ফাকে গল্প আড্ডা তো চলেই। বলতে গেলে রাতভর। কেউ কেউ সময় সুযোগ আর ক্লান্তির দোহাই দিয়ে একটু একটু করে ঘুমিয়েও নেই। টের পাই না আসলে ঠিক কোন দিকে কোথায় যাচ্ছি। লঞ্চটাই ঠিক কোন জায়গায় আছে। আসপাশে কোন গ্রাম শহর মহকুমা! 
    এইভাবে একসময় আকাশে সূর্য উঠে যায়। আমরা জানি আমাদের লঞ্চ যাত্রা শেষ হবে সকাল ৭টায়। তারও অনেক আগে সূর্য উঠে। পৃথিবী ঘুমের না, মনে করাইয়া দেয় আকাশ। ঘুম ঘুম চোখে আমরা দেখি লঞ্চ এসে একটা ভাঙাচোড়া ঘাটে এসে থামলো। এমন ভাঙাচোড়া ঘাটে এই লঞ্চ আরও আগেও যাত্রি উঠাইছে নামাইছে। তবে এই ঘাটটা বিশেষ। কারণ এইটার নাম মনপুরা। মনপুরা হচ্ছে ভোলার সবশেষ স্টেশন। এবং মেঘনার যত মাছ ঢাকায় আসে তার একটা বড় অংশ এখান থেকেই আসে। তবে নতুন কোনও যাত্রী যদি ঘাটের নাম জানতে চায় তার জন্য মহা বিপদ। কারণ অধিকাংশ ঘাটগুলোতেই ঠিক ঠিক জেটি টা লাগানো নেই। যেমন হাতিয়ার একমাত্র জেটিতে লাগানো চট্টগ্রামের একটা জেটি। মনপুরা ছেরে যখন হাতিয়ার দিকে যাচ্ছি, ততক্ষণে চারপাশে আরও আরও দ্বীপ চোখে পড়ছে। যেগুলোতে কেওড়া বনে ভর্তি। কোনও কোনও দ্বীপে তো মনে হয় বসতিও নাই। যেহেতু নদীর পাড় ঘেষে কোনও বসতি চোখে পড়লো না, মনে হইলো ভেতরেও নাই। ভাবতে ভাবতে সকাল সাতটা বেজে গেলো আর আমরা হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে আইসা লঞ্চ থেকে নেমে গেলাম। 

    হাতিয়া নামার পর ভুলে গেছি কিভাবে নিঝুম দ্বীপ যাইতে হয়। তবে একটা বিষয় মাথায় ছিলো, লোকাল লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যাওয়া যাবে না। তাতে হিতে বিপরীত যা হতে পারে, সব কিছুর খরচ বেড়ে যেতে পারে দ্বীগুণ। এই চিন্তায় ঘাটে নেমেই ফোন করলাম অবকাশ নিঝুম রিসোর্টের কেয়ারটেকারের কাছে। তিনি জানাইলেন তমরুদ্দি থেকে একটা অটো নিয়ে বা মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে মুক্তারিয়া ঘাট। সেখান থেকেই আসলে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ দুটি পৃথক দ্বীপ হিসেবে নিজের ঘোষণা করেছে। ভাড়া বলে দিয়েছিলো সর্বোচ্চ আটশ টাকা। কিন্তু কোনও অটোই এই ভাড়ায় রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত ৯শ টাকায় রফা হলো অটোর। পাঁচ জনকে ঘন্টা খানেকেরও কিছু বেশী সময় পর নিয়ে মুক্তারিয়া ঘাটে নামাইলেন। ততক্ষণে পেটের ভেতর বাঘ ঢুকে গেছে। কিন্তু ঐ ঘাটে খাবার দোকানে বলতে কেবল আটার গুলগুইল্যা আর কিছু বিস্কুট। এক প্যাকেট বিস্কুট আমরা সাবার করলাম সেইখানে। তারপর অপেক্ষা করলাম ফেরির জন্য। এইখানে নৌকা দিয়ে পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছাইতে হয়। ঐ পাড়েই নিঝুম দ্বীপ দেখা যায়। তবে থাকা খাওয়া বা ঘোরা ফেরার জন্য কেবল ঐপাড় গেলেই হয় না, যাইতে হয় দ্বীপের অন্য প্রান্তে। সেটাকে বলে নামার বাজার। এই জায়গাটাও এমনিতে চমৎকার। হো হো বাতাস বইছে। ঝলমলে রোদ। একদিকে সমুদ্র। আর একদিকে মেঘনার শেষ সীমানা। আর অন্যপাশে দ্বীপ। যেখানে অবস্থান করছি সেইটাও দ্বীপ। ভাবতেই ভালো লাগে। এইসব ভাবলে চলবে না। ঐ পাড়ে যাইতে হবে। যার জন্য আসছি। যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই মঙ্গল ভেবে ট্রলার রিজার্ভ করে ফেললাম। ১শ টাকার ভাড়া ৩শ টাকায়! নয়তো এখানে দেড় ঘন্টাও বসাইয়া রাখতে পারে এই ভয়ে। উঠলাম ট্রলারে। দুই পাড়ের মাঝামাঝি গিয়ে আমাদের ট্রলার বন্ধ হয়ে গেলো। সমুদ্রমুখী প্রবল স্রোতে ট্রলার তখন সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছে একটু একটু করে। যদিও মূল সমুদ্র বহু দূর। তবুও নষ্ট ট্রলারে সমুদ্রমুখী যাওয়া ভয়েরই কারণ বটে। অবশ্য যতটা ভয় আমরা পেতে পারতাম ততটা যেমন পাই নাই, ঠিক ততটা সময়ও লাগে নি ট্রলার ঠিক হইতে। নিঝুম দ্বীপে নামলাম। নেমে মনে হইলো হ্যা, এইখানেই আমরা আসতে চাইছিলাম। এইটা আদতেই একটা নিঝুম দ্বীপ। 
    নিঝুম দ্বীপের হরিণ

    ঘাটে নামার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো আমাদের নিয়ে পরোক্ষভাবে টানাটানি। আমরা কিসে করে নামার বাজার যাবো। কারণ ঐখানেই যেতে হবে। না গিয়ে উপায় নেই। ভাবছিলাম রিক্সা পেলে রিক্সায় করে ধীরে ধীরে যাইতে থাকবো চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে। রিকসা পাওয়া গেলো না। অগত্যা মোটর সাইকেলে চরে বসলাম। তিনটা মোটরসাইকেলে পাঁচজন যাত্রী। বাইক ছাড়ার পর থেকেই চারপাশে কেবল কেওড়া বন। অনেকটা সুন্দরবনের মতোই। তবে পুরোপুরি না। হয়ত শতকরা ২০ভাগ! বাইকওয়ালা বলছিলো বিকেল বেলা এই পাকা রাস্তার পাশেও হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। খুব বেশীক্ষণ লাগলো না। দশ মিনিটের মতো। আমরা চলে এলাম নামারপাড়া বাজার। মানে নিঝুম দ্বীপের মূল পয়েন্টে। এই বাজারে বসেও সমুদ্রের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। সকাল সকাল নির্জনতার সুযোগ (কখনও ভোরে) পেলে বাজারেও আসে হরিণ। এই রকম ছিলো এক সময়কার অবস্থা। আমরা বাজারে পৌঁছানোর সাথে সাথেই কেয়ারটেকার আমাদের ব্যাগপত্র নিতে এলো। দেখিয়ে নিয়ে গেলো রিসোর্টে। বর্ষাকাল বলে এখন সেখানে পর্যটক নেই। পুরো দ্বীপের মেহমান আমরা পঞ্চপাণ্ডবই। রুমে ফিরেই ফ্রেস হয়ে বের হয়ে পরলাম সমুদ্র দেখবো বলে। আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। তাই রিস্ক হবে ভেবে আর ক্যামেরা নেই নি। আমরা চাইতেছিলাম সমুদ্রের পাড়ে থাকতেই একটা ঝুম বৃষ্টি নামুক। আর বৃষ্টির সময় সমুদ্রের চেহারাটা কেমন হয় একটু তার পাড়ে দাঁড়ায়ে দেখি। যেই দৃশ্য সমুদ্রপাড়ের মানুষ নিয়মিতই দেখে। 
    নিঝুম দ্বীপ এর সমুদ্র সৈকত

    নামারপাড়া বাজার থেকে বিচের দিকে যেতে যেতে এক দঙ্গল পুঁচকে আমাদের সাথে নাছোরবান্দার মতো লেগেছিলো। কোনওভাবেই তাদের এড়াতে পারিনি। তবে বিচ আমাদের খুবই ভালো লেগেছে। নির্ঝঞ্ঝাট, ভিড় কোলাহলহীন এবং একটু অন্য রকম। বিচের সবটা তখন ঘোরা গয়নি। যেই সবটায় অন্য সবাই যায় নি, সেখানটায় আমি একা গেছি। পরের দিন ভোরে। বিচ থেকে ফিরে আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি। এক হোটেলে। এক কেজি কাকড়া ভুনা, আর সাথে নদীর তাজা পাবদা মাছ আর ডাল, সবজি।  
    এই রকম কেওড়া বন আর খাল পাড় হয়ে হরিণ দেখতে যাইতে হয়
    দুপুরে খাওয়ার পর টিমের সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সবাই ঘুম দেয়। আমি বের হয়ে নামার বাজারের আশপাশের কিছু জায়গা ঘুরে দেখতে চেষ্টা করি। সম্প্রতি নির্মিত একটা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পাখির চোখে নিঝুম দ্বীপ দেখি। ফিরে এসেও দেখি তাদের ঘুম ভাঙে না। ডেকে তুললাম সবাইকে। বললাম, এখন না উঠলে তোমরা হরিণ দেখতে পাবা না। এই কথা বলার সাথে সাথে সকলের ঘুম ভেঙে গেলো। একটা নৌকা ভাড়া করা হইলো। বৈঠা নৌকা। খালধরে বনের এক পাশ পার হয়ে নদীর পাড়ে যাইতে হয় এই নৌকা দিয়ে। তারপর সেখানে নদীর পাড়ে মাঠে নেমে ঢুকতে হয় কেওড়া বনে। এই বনেই হরিণ থাকে। মাঝে মাঝে যেখানে বন থেকে বাইরে বের হয়ে আসে সেই হরিণ। মাঠে গরুদের মতো এসে ঘাস খায়। তো আমরা নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখলাম ভাটার টানে খালে পানি নাই। এই কারণে আমরা হেটে গেলাম অনেকটা। হাটু পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি করে খালের যেখানটায় পানি একটু বেশী, সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। নৌকায় করে আমরা বনের ভিতর দিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো এখানেই হরিণ পেয়ে যাবো। পাইলাম না। পুরো সফরের মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার যোগার দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। নৌকা চালক গাইড হিসেবে আমাদেরকে বনের ভেতর নিয়ে গেলেন। বনে ঢোকার মিনিট খানেকের মাঝেই হরিণের দেখা পেলাম। একটা দুইটা না। বেশ কয়েকটা। ছবিটবি তোলা শেষ হয়ে গেলে ফিরে আসলাম। প্রথম ইনিংসে তিন জন যাওয়ার পর, দ্বিতীয় ইনিংসে গেলো বাকি দুই জন। তারা আমাদের চেয়ে বেশী হরিণ দেখলো। তারা বের হওয়ার পর দেখা গেলো, কিছু হরিণ মাঠেই চলে এসেছে। নিঝুম দ্বীপে হরিণ দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মোটামোটি এই রকম বা এরচে ভালো। এরচে খারাপ অভিজ্ঞতা হইছে এমন কারো কাছ থেকে শুনিনাই। সন্ধ্যাটা সেই খাল, বন আর মাঠ ঘিরেই কাটালো। এক কথায় একটা চমৎকার অভিজ্ঞতাও। রুমে ফিরে এসে আবারো ফ্রেস হওয়া। তারপর সন্ধ্যার নাস্তা করতে গিয়ে দেখা হলো স্থানীয় নিঝুম দ্বীপ পুলিশ ফারির ইনচার্জ সাব ইনস্পেক্টরের সাথে। ভদ্রলোক আমারকে চা খাওয়াতে চাইলেন, উল্টো আমরা উনাকে চা খাওয়ায়ে দিলাম। ;) 

    রাতের খাবারের পর আর কোনও অ্যানার্জি ছিলো না। তাই যে যার মতো দ্রুত শয্যা গ্রহণ করি আমরা। কথা ছিলো পরদিন ভোরে উঠে সি বিচ এর যেই দিকটায় যাওয়া হয় নি, সেই দিকটায় যাবো। ক্লান্ত সবাই ঘুমাইলো। আর আমি একা ঘুরে আসলাম বিচের অন্য একটা প্রান্ত। অবশ্য পুরোটা দ্বীপের এক প্রান্তই তো সমুদ্র। কিন্তু বিচ নেই সব দিকে। ঐ একটা দিকেই আছে বলা যায়। নিঝুম দ্বীপে আমাদের থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে। কারণ, হাতিয়া থেকে ঢাকার উদ্যেশ্যে একটিই লঞ্চ আসে। তাই এই লঞ্চ মিস করলে বিপদ। আর লঞ্চটাও ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারোটায়। কিন্তু নিঝুম দ্বীপ থেকে হাতিয়া আসতে কমপক্ষে সময় লাগে ২ ঘন্টা। তার মানে আপনি যদি পরদিন ফিরতে চান আপনাকে ঘুম থেকে উঠেই হাতিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তবে হ্যা, আপনি যদি নিঝুম দ্বীপে আসার পথেই ফিরতে চান তাহলে অবশ্যই সকাল নয়টার মধ্যে মটর সাইকেলে করে রওনা দিতে হবে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে। আর নয়তো নিঝুম দ্বীপ থেকে প্রতিদিন সকালে মাছ নিয়ে একটা ট্রলার আসে তমরুদ্দিন। এই ট্রলারে তমরুদ্দিন পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সাধারণত লঞ্চ ছাড়ে না। তবে ট্রলার ওয়ালারও চায় না লঞ্চ দেরি করুক। তাই এই ট্রলারে করেই সরাসরি হাতিয়া চলে আসা অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরাও সেই পথেই হাতিয়া ফিরেছি। এই জার্নিটাও আরামদায়কই ছিলো। আমাদের ট্রলার নিঝুম রিসোর্টের সামনে থেকে ছেড়েছে সাড়ে নয়টায়। আর বারোটায় এসে হাতিয়ায় লঞ্চে উঠি। সাড়ে বারোটায় লঞ্চ ছাড়ার পর, পরদিন সকাল আটটায় আমরা ঢাকার সদরঘাটে নেমেছি। দিনের সময়কার লঞ্চ জার্নিটা ছিলো দুর্দান্ত। তবে ফেরার সময় রাতে আমরা বিরক্ত বোধ করছি। যদিও এইটাই স্বাভাবিক তা কিন্তু নয়। তবে সব মিলে পুরো সফর ছিলো দুর্দান্ত। সেই কথা তো আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

    নিঝুম দ্বীপের পথে

    at রবিবার, আগস্ট ১৪, ২০১৬  |  No comments



    এরপর আর মেঘদল, মহিনের ঘোড়াগুলি, পিংক ফ্লয়েড, রবিশংকর, ইনারিতু কিছুই ভাল্লাগেনা। এমন একটা মুহূর্ত অনেকটা হ্যাংআউটের মতো। অথচ নেশা টেশা কিচ্ছু করিনাই। কেন ভাল্লাগেনা ভেবে কোনও উত্তর না পাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেলো। মন ভালো করতে হবে। তার জন্য চাই বিশেষ কিছু। কিন্তু বিশেষ কিছুটা কী? উত্তর জানা নাই। এইসবের সাথে আবার যোগ হয় গুলশান হামলা, শোলাকিয়া ঈদের জামাত, নামাজ না পড়া খারাপ মানুষ, ব্যাচেলর বিড়ম্বনা! সবকিছু মিলে একটা হচপচ অবস্থা। এই যেমন দুপুর দুইটার সংবাদের রানডাউন (লাইনআপ), হেডলাইন, এডিটর সব রেডি কিন্তু লিড আইটেমের স্ক্রিপ্ট নাই, রিপোর্টার নাই, ফুটেজ নাই অবস্থা। এই অবস্থা থেকেও যেমন নিউজরুম সংকট থেকে উৎরায় তেমন আমিও উৎরাইলাম। খালিয়াজুরির সফল ট্যুরের পর মোটামোটি একটা দল হইছিলো আমগো। যারা বিরিশিরির মতো দুর্বল পর্যটন এলাকাতেও গেছিলাম দল বেধে। তাদের স্মরণাপন্ন হইলাম। প্রত্যেকরে ফেসবুকে নক করে বলা গেলো, চল দ্বীপান্তর হই। বলতেই এক একটা হই হই করে রাজী। আরে কি সব্বনাশ! আমিতো ভাবছিলাম তরা কেউ যাবি না, আমি একলাই দাও মেরে আসবো। এখন কি হবে? যা থাকে কপালে। কপালের নাম গোপাল, আমার কপালের নাম রাজ কপাল। এই বলে সবাইরে নিয়েই যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
    হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের মাঝের মেঘনা-বঙ্গোপসাগর চ্যানেলে এ
    সেই অনুপাতে দিন তারিখ ঠিক হইলো। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না, ভগবান ইচ্ছা ঠাকুরনেরও তো চাইতে হবে। এই অবস্থায় দিন যত আগায় এক একজন করে উইকেট পড়তে থাকে। এগারোজনের মধ্যে ৬ উইকেট শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত ঝড়ে যায়। কী আর করা! সিক্স-এ সাইড টুর্নামেন্টও হইলো না, অগত্যা ৫ জনই সই। একা যাওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বড় দল, তাও বিসর্জন দিয়ে ছোট দল নিয়েই একদিন বৈকালে উইঠ্যা পড়লাম হাতিয়াগামী এমভি ফারহান-৪ এ। বাহ্‌, সদরঘাট থেকে ইয়া বড় একটা লঞ্চ দিব্বি পানিতে ভাসতে ভাসতে আমাদের নিয়ে চললো। যাইতে শুরু করলাম। বুড়িগঙ্গা পাড় হয়ে শীতলক্ষায় পড়ার পর নদীর পাড় ঘেষে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করলো। মালায়ালাম ছবির গ্রামগুলোর মতো শীতলক্ষার পাড় ধরে চমৎকার কিছু জায়গা দেখলাম। মনে হলো নদী থেকে নয়, একবার কেবল হাঁটার জন্য সেখানে আসা উচিত। তো এইরকম চারপাশ আমরা দ্রুত অতিক্রম করতেছিলাম। আর দ্রুতই সন্ধ্যাও নেমে এলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চেয়ার টেনে লঞ্চের কেবিনের সামনে বসে পড়লাম আমরা। আড্ডা দিতে। আড্ডায় সবার আগে উঠে এলো এক সময় ঢাকা শহরের ভিনদেশী পর্যটকদের কোনও আয়োজন হলে সন্ধ্যাটা বুড়িগঙ্গার নৌবিহার দিয়ে শেষ হইতো। এখন হয় পানশালায়। এইভাবে বদলাইতেছে জীবন ও সমাজ। হইতেছি আধুনিক ও ডিজিটাল। 
    এইটা সফরের আইকনিক ছবি। নিঝুম দ্বীপ বিচে।

     সময় গড়িয়ে আমাদের বহন করা লঞ্চ মেঘনায় গড়ায়। চাঁদপুর লঞ্চঘাট দূর থেকে দেখি। শহরে নদীর পাড় ধরে সার বদ্ধ আলোর দল। আর মাঝ নদীতে মাছ ধরা ইলিশের নৌকায়ও। মুগ্ধতা নিয়ে সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফাকে ফাকে গল্প আড্ডা তো চলেই। বলতে গেলে রাতভর। কেউ কেউ সময় সুযোগ আর ক্লান্তির দোহাই দিয়ে একটু একটু করে ঘুমিয়েও নেই। টের পাই না আসলে ঠিক কোন দিকে কোথায় যাচ্ছি। লঞ্চটাই ঠিক কোন জায়গায় আছে। আসপাশে কোন গ্রাম শহর মহকুমা! 
    এইভাবে একসময় আকাশে সূর্য উঠে যায়। আমরা জানি আমাদের লঞ্চ যাত্রা শেষ হবে সকাল ৭টায়। তারও অনেক আগে সূর্য উঠে। পৃথিবী ঘুমের না, মনে করাইয়া দেয় আকাশ। ঘুম ঘুম চোখে আমরা দেখি লঞ্চ এসে একটা ভাঙাচোড়া ঘাটে এসে থামলো। এমন ভাঙাচোড়া ঘাটে এই লঞ্চ আরও আগেও যাত্রি উঠাইছে নামাইছে। তবে এই ঘাটটা বিশেষ। কারণ এইটার নাম মনপুরা। মনপুরা হচ্ছে ভোলার সবশেষ স্টেশন। এবং মেঘনার যত মাছ ঢাকায় আসে তার একটা বড় অংশ এখান থেকেই আসে। তবে নতুন কোনও যাত্রী যদি ঘাটের নাম জানতে চায় তার জন্য মহা বিপদ। কারণ অধিকাংশ ঘাটগুলোতেই ঠিক ঠিক জেটি টা লাগানো নেই। যেমন হাতিয়ার একমাত্র জেটিতে লাগানো চট্টগ্রামের একটা জেটি। মনপুরা ছেরে যখন হাতিয়ার দিকে যাচ্ছি, ততক্ষণে চারপাশে আরও আরও দ্বীপ চোখে পড়ছে। যেগুলোতে কেওড়া বনে ভর্তি। কোনও কোনও দ্বীপে তো মনে হয় বসতিও নাই। যেহেতু নদীর পাড় ঘেষে কোনও বসতি চোখে পড়লো না, মনে হইলো ভেতরেও নাই। ভাবতে ভাবতে সকাল সাতটা বেজে গেলো আর আমরা হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে আইসা লঞ্চ থেকে নেমে গেলাম। 

    হাতিয়া নামার পর ভুলে গেছি কিভাবে নিঝুম দ্বীপ যাইতে হয়। তবে একটা বিষয় মাথায় ছিলো, লোকাল লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যাওয়া যাবে না। তাতে হিতে বিপরীত যা হতে পারে, সব কিছুর খরচ বেড়ে যেতে পারে দ্বীগুণ। এই চিন্তায় ঘাটে নেমেই ফোন করলাম অবকাশ নিঝুম রিসোর্টের কেয়ারটেকারের কাছে। তিনি জানাইলেন তমরুদ্দি থেকে একটা অটো নিয়ে বা মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে মুক্তারিয়া ঘাট। সেখান থেকেই আসলে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ দুটি পৃথক দ্বীপ হিসেবে নিজের ঘোষণা করেছে। ভাড়া বলে দিয়েছিলো সর্বোচ্চ আটশ টাকা। কিন্তু কোনও অটোই এই ভাড়ায় রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত ৯শ টাকায় রফা হলো অটোর। পাঁচ জনকে ঘন্টা খানেকেরও কিছু বেশী সময় পর নিয়ে মুক্তারিয়া ঘাটে নামাইলেন। ততক্ষণে পেটের ভেতর বাঘ ঢুকে গেছে। কিন্তু ঐ ঘাটে খাবার দোকানে বলতে কেবল আটার গুলগুইল্যা আর কিছু বিস্কুট। এক প্যাকেট বিস্কুট আমরা সাবার করলাম সেইখানে। তারপর অপেক্ষা করলাম ফেরির জন্য। এইখানে নৌকা দিয়ে পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছাইতে হয়। ঐ পাড়েই নিঝুম দ্বীপ দেখা যায়। তবে থাকা খাওয়া বা ঘোরা ফেরার জন্য কেবল ঐপাড় গেলেই হয় না, যাইতে হয় দ্বীপের অন্য প্রান্তে। সেটাকে বলে নামার বাজার। এই জায়গাটাও এমনিতে চমৎকার। হো হো বাতাস বইছে। ঝলমলে রোদ। একদিকে সমুদ্র। আর একদিকে মেঘনার শেষ সীমানা। আর অন্যপাশে দ্বীপ। যেখানে অবস্থান করছি সেইটাও দ্বীপ। ভাবতেই ভালো লাগে। এইসব ভাবলে চলবে না। ঐ পাড়ে যাইতে হবে। যার জন্য আসছি। যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই মঙ্গল ভেবে ট্রলার রিজার্ভ করে ফেললাম। ১শ টাকার ভাড়া ৩শ টাকায়! নয়তো এখানে দেড় ঘন্টাও বসাইয়া রাখতে পারে এই ভয়ে। উঠলাম ট্রলারে। দুই পাড়ের মাঝামাঝি গিয়ে আমাদের ট্রলার বন্ধ হয়ে গেলো। সমুদ্রমুখী প্রবল স্রোতে ট্রলার তখন সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছে একটু একটু করে। যদিও মূল সমুদ্র বহু দূর। তবুও নষ্ট ট্রলারে সমুদ্রমুখী যাওয়া ভয়েরই কারণ বটে। অবশ্য যতটা ভয় আমরা পেতে পারতাম ততটা যেমন পাই নাই, ঠিক ততটা সময়ও লাগে নি ট্রলার ঠিক হইতে। নিঝুম দ্বীপে নামলাম। নেমে মনে হইলো হ্যা, এইখানেই আমরা আসতে চাইছিলাম। এইটা আদতেই একটা নিঝুম দ্বীপ। 
    নিঝুম দ্বীপের হরিণ

    ঘাটে নামার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো আমাদের নিয়ে পরোক্ষভাবে টানাটানি। আমরা কিসে করে নামার বাজার যাবো। কারণ ঐখানেই যেতে হবে। না গিয়ে উপায় নেই। ভাবছিলাম রিক্সা পেলে রিক্সায় করে ধীরে ধীরে যাইতে থাকবো চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে। রিকসা পাওয়া গেলো না। অগত্যা মোটর সাইকেলে চরে বসলাম। তিনটা মোটরসাইকেলে পাঁচজন যাত্রী। বাইক ছাড়ার পর থেকেই চারপাশে কেবল কেওড়া বন। অনেকটা সুন্দরবনের মতোই। তবে পুরোপুরি না। হয়ত শতকরা ২০ভাগ! বাইকওয়ালা বলছিলো বিকেল বেলা এই পাকা রাস্তার পাশেও হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। খুব বেশীক্ষণ লাগলো না। দশ মিনিটের মতো। আমরা চলে এলাম নামারপাড়া বাজার। মানে নিঝুম দ্বীপের মূল পয়েন্টে। এই বাজারে বসেও সমুদ্রের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। সকাল সকাল নির্জনতার সুযোগ (কখনও ভোরে) পেলে বাজারেও আসে হরিণ। এই রকম ছিলো এক সময়কার অবস্থা। আমরা বাজারে পৌঁছানোর সাথে সাথেই কেয়ারটেকার আমাদের ব্যাগপত্র নিতে এলো। দেখিয়ে নিয়ে গেলো রিসোর্টে। বর্ষাকাল বলে এখন সেখানে পর্যটক নেই। পুরো দ্বীপের মেহমান আমরা পঞ্চপাণ্ডবই। রুমে ফিরেই ফ্রেস হয়ে বের হয়ে পরলাম সমুদ্র দেখবো বলে। আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। তাই রিস্ক হবে ভেবে আর ক্যামেরা নেই নি। আমরা চাইতেছিলাম সমুদ্রের পাড়ে থাকতেই একটা ঝুম বৃষ্টি নামুক। আর বৃষ্টির সময় সমুদ্রের চেহারাটা কেমন হয় একটু তার পাড়ে দাঁড়ায়ে দেখি। যেই দৃশ্য সমুদ্রপাড়ের মানুষ নিয়মিতই দেখে। 
    নিঝুম দ্বীপ এর সমুদ্র সৈকত

    নামারপাড়া বাজার থেকে বিচের দিকে যেতে যেতে এক দঙ্গল পুঁচকে আমাদের সাথে নাছোরবান্দার মতো লেগেছিলো। কোনওভাবেই তাদের এড়াতে পারিনি। তবে বিচ আমাদের খুবই ভালো লেগেছে। নির্ঝঞ্ঝাট, ভিড় কোলাহলহীন এবং একটু অন্য রকম। বিচের সবটা তখন ঘোরা গয়নি। যেই সবটায় অন্য সবাই যায় নি, সেখানটায় আমি একা গেছি। পরের দিন ভোরে। বিচ থেকে ফিরে আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি। এক হোটেলে। এক কেজি কাকড়া ভুনা, আর সাথে নদীর তাজা পাবদা মাছ আর ডাল, সবজি।  
    এই রকম কেওড়া বন আর খাল পাড় হয়ে হরিণ দেখতে যাইতে হয়
    দুপুরে খাওয়ার পর টিমের সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সবাই ঘুম দেয়। আমি বের হয়ে নামার বাজারের আশপাশের কিছু জায়গা ঘুরে দেখতে চেষ্টা করি। সম্প্রতি নির্মিত একটা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পাখির চোখে নিঝুম দ্বীপ দেখি। ফিরে এসেও দেখি তাদের ঘুম ভাঙে না। ডেকে তুললাম সবাইকে। বললাম, এখন না উঠলে তোমরা হরিণ দেখতে পাবা না। এই কথা বলার সাথে সাথে সকলের ঘুম ভেঙে গেলো। একটা নৌকা ভাড়া করা হইলো। বৈঠা নৌকা। খালধরে বনের এক পাশ পার হয়ে নদীর পাড়ে যাইতে হয় এই নৌকা দিয়ে। তারপর সেখানে নদীর পাড়ে মাঠে নেমে ঢুকতে হয় কেওড়া বনে। এই বনেই হরিণ থাকে। মাঝে মাঝে যেখানে বন থেকে বাইরে বের হয়ে আসে সেই হরিণ। মাঠে গরুদের মতো এসে ঘাস খায়। তো আমরা নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখলাম ভাটার টানে খালে পানি নাই। এই কারণে আমরা হেটে গেলাম অনেকটা। হাটু পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি করে খালের যেখানটায় পানি একটু বেশী, সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। নৌকায় করে আমরা বনের ভিতর দিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো এখানেই হরিণ পেয়ে যাবো। পাইলাম না। পুরো সফরের মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার যোগার দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। নৌকা চালক গাইড হিসেবে আমাদেরকে বনের ভেতর নিয়ে গেলেন। বনে ঢোকার মিনিট খানেকের মাঝেই হরিণের দেখা পেলাম। একটা দুইটা না। বেশ কয়েকটা। ছবিটবি তোলা শেষ হয়ে গেলে ফিরে আসলাম। প্রথম ইনিংসে তিন জন যাওয়ার পর, দ্বিতীয় ইনিংসে গেলো বাকি দুই জন। তারা আমাদের চেয়ে বেশী হরিণ দেখলো। তারা বের হওয়ার পর দেখা গেলো, কিছু হরিণ মাঠেই চলে এসেছে। নিঝুম দ্বীপে হরিণ দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মোটামোটি এই রকম বা এরচে ভালো। এরচে খারাপ অভিজ্ঞতা হইছে এমন কারো কাছ থেকে শুনিনাই। সন্ধ্যাটা সেই খাল, বন আর মাঠ ঘিরেই কাটালো। এক কথায় একটা চমৎকার অভিজ্ঞতাও। রুমে ফিরে এসে আবারো ফ্রেস হওয়া। তারপর সন্ধ্যার নাস্তা করতে গিয়ে দেখা হলো স্থানীয় নিঝুম দ্বীপ পুলিশ ফারির ইনচার্জ সাব ইনস্পেক্টরের সাথে। ভদ্রলোক আমারকে চা খাওয়াতে চাইলেন, উল্টো আমরা উনাকে চা খাওয়ায়ে দিলাম। ;) 

    রাতের খাবারের পর আর কোনও অ্যানার্জি ছিলো না। তাই যে যার মতো দ্রুত শয্যা গ্রহণ করি আমরা। কথা ছিলো পরদিন ভোরে উঠে সি বিচ এর যেই দিকটায় যাওয়া হয় নি, সেই দিকটায় যাবো। ক্লান্ত সবাই ঘুমাইলো। আর আমি একা ঘুরে আসলাম বিচের অন্য একটা প্রান্ত। অবশ্য পুরোটা দ্বীপের এক প্রান্তই তো সমুদ্র। কিন্তু বিচ নেই সব দিকে। ঐ একটা দিকেই আছে বলা যায়। নিঝুম দ্বীপে আমাদের থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে। কারণ, হাতিয়া থেকে ঢাকার উদ্যেশ্যে একটিই লঞ্চ আসে। তাই এই লঞ্চ মিস করলে বিপদ। আর লঞ্চটাও ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারোটায়। কিন্তু নিঝুম দ্বীপ থেকে হাতিয়া আসতে কমপক্ষে সময় লাগে ২ ঘন্টা। তার মানে আপনি যদি পরদিন ফিরতে চান আপনাকে ঘুম থেকে উঠেই হাতিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তবে হ্যা, আপনি যদি নিঝুম দ্বীপে আসার পথেই ফিরতে চান তাহলে অবশ্যই সকাল নয়টার মধ্যে মটর সাইকেলে করে রওনা দিতে হবে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে। আর নয়তো নিঝুম দ্বীপ থেকে প্রতিদিন সকালে মাছ নিয়ে একটা ট্রলার আসে তমরুদ্দিন। এই ট্রলারে তমরুদ্দিন পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সাধারণত লঞ্চ ছাড়ে না। তবে ট্রলার ওয়ালারও চায় না লঞ্চ দেরি করুক। তাই এই ট্রলারে করেই সরাসরি হাতিয়া চলে আসা অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরাও সেই পথেই হাতিয়া ফিরেছি। এই জার্নিটাও আরামদায়কই ছিলো। আমাদের ট্রলার নিঝুম রিসোর্টের সামনে থেকে ছেড়েছে সাড়ে নয়টায়। আর বারোটায় এসে হাতিয়ায় লঞ্চে উঠি। সাড়ে বারোটায় লঞ্চ ছাড়ার পর, পরদিন সকাল আটটায় আমরা ঢাকার সদরঘাটে নেমেছি। দিনের সময়কার লঞ্চ জার্নিটা ছিলো দুর্দান্ত। তবে ফেরার সময় রাতে আমরা বিরক্ত বোধ করছি। যদিও এইটাই স্বাভাবিক তা কিন্তু নয়। তবে সব মিলে পুরো সফর ছিলো দুর্দান্ত। সেই কথা তো আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

    Read More

    বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১৬

    চারপাশের পরিবেশটা এমন যে সিনেমা দেখে রিভিউ লেখার মতো স্বস্তিদায়ক মুড আসলে নাই তারপরও নানা কারণে লিখতে বসছি শুরুতেই এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে বলি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এবারের ঈদ একটা টার্নিং পয়েন্ট হইতে পারে সেই টার্নিং পয়েন্টটা আমাদের নিয়মিত নির্মাতারা অনুভব করতে পারলে সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রির লাভ, নিজেদেরও লাভ এইটাই ছবির রিভিউ লিখতে বসার প্রধান কারণ আর আর কারণগুলো মূখ্য নয়, গৌন তাই সেগুলো অনুল্লেখ্যই থাকলো


    শিকারি ছবি দেখতে আমার বিশেষ কোনও আগ্রহ ছিলো না আর দশটা বাংলাদেশী বাণিজ্যিক ছবির মতোই আগ্রহ তবে একটা বিষয় খুব চোখে পড়েছে, এই ছবির নায়ক সাকিব খান কে নিয়ে আমাদের অনলাইন রূচিবান স্বদেশবানদের সুনামের হুরহুরি বহুদিন আগে কোনও একজন বলছিলো, আমাদের দেশের মানুষ নিজের দেশের পণ্য বিদেশ ফেরত হইলে তা বেশি দাম দিয়া কিনতে আগ্রহ দেখায় কারণ ঐটা বিদেশী পণ্য কিন্তু নিজের দেশের পণ্যটারে নিজের ব্যবহারের উপযুক্ত মনে করে না অথচ এই দেশের আলো বাতাসেই আমরা বড় হইছি বড় হওয়ার পর প্রয়োজন মনে করি বিদেশী পণ্য সাকিবকে নিয়া অতি মাতামাতির কারণে আমার এই রকম মনে হইছে আর কি তবে মাতামাতি ভালো বিশেষ করে সব ধরণের তারকাদের নিয়েই তো মাতামাতি হবে নইলে তারা তারকা কেনো? তবে যাদেরকে কখনো সাকিবের ছবি হলে গিয়ে দেখতে শুনি নাই তারাই যখন সাকিব নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেন তখন কিছুটা প্রশ্ন জাগতেই পারে সেই কারণে শিকারি দেখার আগ্রহ তৈরি হয় এর আগে অবশ্য একটা কথা না বললেই নয় তা হইলো আমি নিয়মিত হলে গিয়া বাংলা সিনেমা দেখি এই কথা শুইন্যা অনেকের চক্ষু কপালেও উঠে আমার অবশ্য মুচকি মুচকি হাসি পায় কারণ, ঐ কপালে ওঠা চোখ দেখতে আমার ভাল্লাগে একই সাথে ছবির কয়েকটা গান দেখে মনে হইছে সাকিবের নতুন লুক, সব্যসাচী চক্রবর্তিও অভিনয় করতেছে ছবিটা দেখাই উচিত তাই ঈদের দিন অর্ধেক ঘুম বাতিল করে জয়কে ডেকে আনলাম ছবি দেখার জন্য সে আসতে আসতে ১০ মিনিট ছবি চলে গেছে
    হলে ঢুকে দেখি কোনও এক ধর্মগুরু পূজার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তার সাথে তার সমর্থক ভক্তঅনুরাগিরা উৎসব করছে এমন পরিস্থিতিতে প্রফেশনাল কিলার হিরো সাকিব এবং কার্য সমাধা করার পরই মূল গল্পে ঢুকে গেলো সিনেমা ভালোই খারাপ না ফর্মুলা ছবি হিসেবে টানটান গল্প রাখার চেষ্টা একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই আর একটা ঘটনা যদিও সবগুলো ঘটনাই ঘটতে যাবে অনুমিত সেইসব অনুমিত ঘটনাগুলোই দেখা যাচ্ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো নির্মাণে অপেক্ষাকৃত ভালো অর্থে বলছি এই কারণে যে, বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশী বা ভারতীয় বাংলা সিনেমার যেই নির্মাণ মান তার সাথে এর একটু পার্থক্য আছে পার্থক্যটা কেমন? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিছুদিন আগেও আমরা দেখে এসেছি সিনেমা চারটা গানের তিনটাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যায়ন যার কোরিগ্রাফার হয়ত কোনও ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঐ গানগুলোকে বারবার দেখিয়ে দেখিয়ে লোকজনকে হলে নেয়া হতো, আর ছবির নির্মাণহতো বাংলাদেশী গড়পড়তা টিভি নাটকের চেয়ে একটু ভালো তো ঐ রকম একটা আশঙ্কা নিয়েই ছবি দেখতে বসেছিলাম কিন্তু সেই আশঙ্কা পুরোপুরি মিলে নি তাই কিছুটা সন্দেহও ছিলো পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা এই রকম বাণিজ্যিক ছবি কি আসলেই বানাতে শুরু করে দিলেন? হ্যা, এই প্রশ্নটাই বাংলাদেশের সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের একটা প্রশ্ন কারণ ফেসবুক মারফতই না, বাস্তবেও দেখলাম সিনেমা হল ভর্তি লোকজন বিকাল সাড়ে পাঁচটার টিকিট তাই অগ্রীম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দুপুর ১টায় যা বিগত কয়েক বছরে কল্পনাতীত সেই কল্পনা যদি বাস্তব হয় তবে প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলা সিনেমা কি তবে সুদিন ফিরে পাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো ধীরে বৎস, ধীরে এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে বাংলা সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের প্রশ্নের উত্তরটাও চলে আসে কারণ, পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা যদি এই মানের ছবিও নিয়মিত বানায় আর তা অনায়াসে আমাদের সিনেমাহলের দর্শকরা লুফে নেবে কারণ আমাদের বাংলাদেশের নির্মাতারা এতটুকুও বানাতে পারছেন না এমনকি অনেক নামি দামি নির্মাতাদের ছবিও তাই বলে ফলে কলকাতার নির্মাতারা হলে জায়গা পাকা করে নিলে এফডিসিতে এখনো যেমন কিছু সিনেমার কাজ চলে, তখন আর কিছুই চলবে না তখন বরংচ সেইসব নির্মাতাদের দক্ষিণী কুশলীদের ভাড়া করা ছাড়া উপায় থাকবে না তাই নিজেদের মান উন্নয়ন খুব জরুরী ঘরের দর্শকদের জন্য, নিজেদের জন্য, নিজেদের সিনেমার জন্য তো বটেই  
    এতক্ষণ ধান বানতে গিয়ে শীবের গীত শোনালাম কি আর করা, কখনো কখনো বৃষ্টির চেয়ে ছাতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে কি না! তোশিকারি একদম গতানুগতিক একটা ফর্মুলা ছবি যার গানগুলোতে আমাদের দেশী নায়ক সাকিবকে নতুন লুকে দেখা গেছে যা বড় পর্দায় দেখে আপনার ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে পুরো ছবির সবচে আরামদায়ক ভিজ্যুয়াল বলতে ঐ গানগুলোই তবে হ্যা, আনুপাতিক হারে ছবির যে নির্মাণ তা মন্দের ভালো অন্তত এই কোয়ালিটিই আপাতত পাতে জুটছে যে এই বেশি এই প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যাক ছবির নির্মাতার নাম বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবির প্রসঙ্গ আসলেও বাংলাদেশী যেই পরিচালকের নাম আমরা জানলাম সেই পরিচালকের নাম জাকির হোসেন সীমান্ত আর ভারতের অংশের পরিচালক ছিলেন জয়দ্বীপ মুখার্জি আইএমডিবি সূত্র বলে জয়দ্বীপ আগে টিভি নির্মাতা ছিলেন বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়াল তিনি বানাইছেন তার মাঝে ব্যোমকেশ উল্লেখযোগ্য একটি তবে দুই দেশের ছবি হইলেও বাংলাদেশের কোনও অংশই ছবির ছিলো না এইটা নামকাওয়াস্তে কেবল

    ছবির গল্প নিয়ে অভিযোগ করতে চাই না কারণ, গল্প নিয়ে প্রত্যাশাই ছিলো না সেই তুলনায় অনেক ভালো গল্প ও চিত্রনাট্য তবে গল্প চিত্রনাট্যের চেয়ে বেশ কিছু মজার ছিলো ছবির সংলাপ এবার আসুন জানি, ছবির গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার কে বা কারা ছবির চিত্রনাট্য বিষয়ক তথ্য খুঁজতে গিয়ে দুই প্রকার তথ্য পাওয়া গেলো উইকিপিডিয়া বলছে পেলে ভট্টাচার্যই ও আব্দুল্লাহ জহির বাবু ছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছে আবার আইএমডিবি বলছে জয়দ্বীপ মুখার্জি ও পেলে ভট্টাচার্য দুজন মিলে লিখেছে আসল সত্য কোনটা তারাই জানে
    ছবিতে সব্যসাচী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখার লোভ ছিলো তাতে টান পড়েছে উল্টো দুই জনের অভিনয়ে বিনোদিত হয়েছি তার একজন হিন্দী ছবির ভিলেন রাহুল দেব আর একজন কলকাতার অভিনয়শিল্পী খরাজ মুখোপাধ্যায় তবে এইসব ভালো মন্দের চেয়ে সবচে বেশী যা ভালো লেগেছে তা হলো ছবি দেখার জন্য মানুষের হলে ভীড় করা দেখে কারণ ভালো মন্দ তো পরে, আগে তো ছবিটা দেখতে হবে নইলে ছবি হবে না ভবিষ্যতে

    শেষ পর্যন্ত যেই কথা বলতে চাই তা হলো এই ছবি লোকজন মজা করে দেখবে ভুলে যাবে মনপুড়া ছবি দেখে আমরা যেমন বেশ কয়েকদিন আলোচনা করেছি কেউ কেউ একাধিকবারও দেখেছি, এই ছবি তেমন নয় কিন্তু চকচকে ঝকঝকে বলে লোকজনের আগ্রহটাও চকচকেই আর এমন আগ্রহ তৈরি করতে না পারলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবি আর বানাইতে হবে না কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসা অনেক ভালো তার চেয়ে

    কি শিকার করলো শিকারি?

    at বৃহস্পতিবার, জুলাই ০৭, ২০১৬  |  2 comments

    চারপাশের পরিবেশটা এমন যে সিনেমা দেখে রিভিউ লেখার মতো স্বস্তিদায়ক মুড আসলে নাই তারপরও নানা কারণে লিখতে বসছি শুরুতেই এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে বলি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এবারের ঈদ একটা টার্নিং পয়েন্ট হইতে পারে সেই টার্নিং পয়েন্টটা আমাদের নিয়মিত নির্মাতারা অনুভব করতে পারলে সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রির লাভ, নিজেদেরও লাভ এইটাই ছবির রিভিউ লিখতে বসার প্রধান কারণ আর আর কারণগুলো মূখ্য নয়, গৌন তাই সেগুলো অনুল্লেখ্যই থাকলো


    শিকারি ছবি দেখতে আমার বিশেষ কোনও আগ্রহ ছিলো না আর দশটা বাংলাদেশী বাণিজ্যিক ছবির মতোই আগ্রহ তবে একটা বিষয় খুব চোখে পড়েছে, এই ছবির নায়ক সাকিব খান কে নিয়ে আমাদের অনলাইন রূচিবান স্বদেশবানদের সুনামের হুরহুরি বহুদিন আগে কোনও একজন বলছিলো, আমাদের দেশের মানুষ নিজের দেশের পণ্য বিদেশ ফেরত হইলে তা বেশি দাম দিয়া কিনতে আগ্রহ দেখায় কারণ ঐটা বিদেশী পণ্য কিন্তু নিজের দেশের পণ্যটারে নিজের ব্যবহারের উপযুক্ত মনে করে না অথচ এই দেশের আলো বাতাসেই আমরা বড় হইছি বড় হওয়ার পর প্রয়োজন মনে করি বিদেশী পণ্য সাকিবকে নিয়া অতি মাতামাতির কারণে আমার এই রকম মনে হইছে আর কি তবে মাতামাতি ভালো বিশেষ করে সব ধরণের তারকাদের নিয়েই তো মাতামাতি হবে নইলে তারা তারকা কেনো? তবে যাদেরকে কখনো সাকিবের ছবি হলে গিয়ে দেখতে শুনি নাই তারাই যখন সাকিব নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেন তখন কিছুটা প্রশ্ন জাগতেই পারে সেই কারণে শিকারি দেখার আগ্রহ তৈরি হয় এর আগে অবশ্য একটা কথা না বললেই নয় তা হইলো আমি নিয়মিত হলে গিয়া বাংলা সিনেমা দেখি এই কথা শুইন্যা অনেকের চক্ষু কপালেও উঠে আমার অবশ্য মুচকি মুচকি হাসি পায় কারণ, ঐ কপালে ওঠা চোখ দেখতে আমার ভাল্লাগে একই সাথে ছবির কয়েকটা গান দেখে মনে হইছে সাকিবের নতুন লুক, সব্যসাচী চক্রবর্তিও অভিনয় করতেছে ছবিটা দেখাই উচিত তাই ঈদের দিন অর্ধেক ঘুম বাতিল করে জয়কে ডেকে আনলাম ছবি দেখার জন্য সে আসতে আসতে ১০ মিনিট ছবি চলে গেছে
    হলে ঢুকে দেখি কোনও এক ধর্মগুরু পূজার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তার সাথে তার সমর্থক ভক্তঅনুরাগিরা উৎসব করছে এমন পরিস্থিতিতে প্রফেশনাল কিলার হিরো সাকিব এবং কার্য সমাধা করার পরই মূল গল্পে ঢুকে গেলো সিনেমা ভালোই খারাপ না ফর্মুলা ছবি হিসেবে টানটান গল্প রাখার চেষ্টা একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই আর একটা ঘটনা যদিও সবগুলো ঘটনাই ঘটতে যাবে অনুমিত সেইসব অনুমিত ঘটনাগুলোই দেখা যাচ্ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো নির্মাণে অপেক্ষাকৃত ভালো অর্থে বলছি এই কারণে যে, বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশী বা ভারতীয় বাংলা সিনেমার যেই নির্মাণ মান তার সাথে এর একটু পার্থক্য আছে পার্থক্যটা কেমন? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিছুদিন আগেও আমরা দেখে এসেছি সিনেমা চারটা গানের তিনটাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যায়ন যার কোরিগ্রাফার হয়ত কোনও ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঐ গানগুলোকে বারবার দেখিয়ে দেখিয়ে লোকজনকে হলে নেয়া হতো, আর ছবির নির্মাণহতো বাংলাদেশী গড়পড়তা টিভি নাটকের চেয়ে একটু ভালো তো ঐ রকম একটা আশঙ্কা নিয়েই ছবি দেখতে বসেছিলাম কিন্তু সেই আশঙ্কা পুরোপুরি মিলে নি তাই কিছুটা সন্দেহও ছিলো পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা এই রকম বাণিজ্যিক ছবি কি আসলেই বানাতে শুরু করে দিলেন? হ্যা, এই প্রশ্নটাই বাংলাদেশের সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের একটা প্রশ্ন কারণ ফেসবুক মারফতই না, বাস্তবেও দেখলাম সিনেমা হল ভর্তি লোকজন বিকাল সাড়ে পাঁচটার টিকিট তাই অগ্রীম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দুপুর ১টায় যা বিগত কয়েক বছরে কল্পনাতীত সেই কল্পনা যদি বাস্তব হয় তবে প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলা সিনেমা কি তবে সুদিন ফিরে পাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো ধীরে বৎস, ধীরে এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে বাংলা সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের প্রশ্নের উত্তরটাও চলে আসে কারণ, পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা যদি এই মানের ছবিও নিয়মিত বানায় আর তা অনায়াসে আমাদের সিনেমাহলের দর্শকরা লুফে নেবে কারণ আমাদের বাংলাদেশের নির্মাতারা এতটুকুও বানাতে পারছেন না এমনকি অনেক নামি দামি নির্মাতাদের ছবিও তাই বলে ফলে কলকাতার নির্মাতারা হলে জায়গা পাকা করে নিলে এফডিসিতে এখনো যেমন কিছু সিনেমার কাজ চলে, তখন আর কিছুই চলবে না তখন বরংচ সেইসব নির্মাতাদের দক্ষিণী কুশলীদের ভাড়া করা ছাড়া উপায় থাকবে না তাই নিজেদের মান উন্নয়ন খুব জরুরী ঘরের দর্শকদের জন্য, নিজেদের জন্য, নিজেদের সিনেমার জন্য তো বটেই  
    এতক্ষণ ধান বানতে গিয়ে শীবের গীত শোনালাম কি আর করা, কখনো কখনো বৃষ্টির চেয়ে ছাতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে কি না! তোশিকারি একদম গতানুগতিক একটা ফর্মুলা ছবি যার গানগুলোতে আমাদের দেশী নায়ক সাকিবকে নতুন লুকে দেখা গেছে যা বড় পর্দায় দেখে আপনার ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে পুরো ছবির সবচে আরামদায়ক ভিজ্যুয়াল বলতে ঐ গানগুলোই তবে হ্যা, আনুপাতিক হারে ছবির যে নির্মাণ তা মন্দের ভালো অন্তত এই কোয়ালিটিই আপাতত পাতে জুটছে যে এই বেশি এই প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যাক ছবির নির্মাতার নাম বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবির প্রসঙ্গ আসলেও বাংলাদেশী যেই পরিচালকের নাম আমরা জানলাম সেই পরিচালকের নাম জাকির হোসেন সীমান্ত আর ভারতের অংশের পরিচালক ছিলেন জয়দ্বীপ মুখার্জি আইএমডিবি সূত্র বলে জয়দ্বীপ আগে টিভি নির্মাতা ছিলেন বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়াল তিনি বানাইছেন তার মাঝে ব্যোমকেশ উল্লেখযোগ্য একটি তবে দুই দেশের ছবি হইলেও বাংলাদেশের কোনও অংশই ছবির ছিলো না এইটা নামকাওয়াস্তে কেবল

    ছবির গল্প নিয়ে অভিযোগ করতে চাই না কারণ, গল্প নিয়ে প্রত্যাশাই ছিলো না সেই তুলনায় অনেক ভালো গল্প ও চিত্রনাট্য তবে গল্প চিত্রনাট্যের চেয়ে বেশ কিছু মজার ছিলো ছবির সংলাপ এবার আসুন জানি, ছবির গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার কে বা কারা ছবির চিত্রনাট্য বিষয়ক তথ্য খুঁজতে গিয়ে দুই প্রকার তথ্য পাওয়া গেলো উইকিপিডিয়া বলছে পেলে ভট্টাচার্যই ও আব্দুল্লাহ জহির বাবু ছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছে আবার আইএমডিবি বলছে জয়দ্বীপ মুখার্জি ও পেলে ভট্টাচার্য দুজন মিলে লিখেছে আসল সত্য কোনটা তারাই জানে
    ছবিতে সব্যসাচী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখার লোভ ছিলো তাতে টান পড়েছে উল্টো দুই জনের অভিনয়ে বিনোদিত হয়েছি তার একজন হিন্দী ছবির ভিলেন রাহুল দেব আর একজন কলকাতার অভিনয়শিল্পী খরাজ মুখোপাধ্যায় তবে এইসব ভালো মন্দের চেয়ে সবচে বেশী যা ভালো লেগেছে তা হলো ছবি দেখার জন্য মানুষের হলে ভীড় করা দেখে কারণ ভালো মন্দ তো পরে, আগে তো ছবিটা দেখতে হবে নইলে ছবি হবে না ভবিষ্যতে

    শেষ পর্যন্ত যেই কথা বলতে চাই তা হলো এই ছবি লোকজন মজা করে দেখবে ভুলে যাবে মনপুড়া ছবি দেখে আমরা যেমন বেশ কয়েকদিন আলোচনা করেছি কেউ কেউ একাধিকবারও দেখেছি, এই ছবি তেমন নয় কিন্তু চকচকে ঝকঝকে বলে লোকজনের আগ্রহটাও চকচকেই আর এমন আগ্রহ তৈরি করতে না পারলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবি আর বানাইতে হবে না কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসা অনেক ভালো তার চেয়ে

    Read More

    এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

    Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম